Biography Bangla
কাজী নজরুল ইসলাম
– রফিকুল ইসলাম
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা সংগীতের ‘বুলবুল’ নামে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপিমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ অনুসরণ ও অনুকরণের কৃত্রিমতা থেকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে ফলপ্রসূ, সেই দিক থেকে তিনি বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার পথিকৃৎ। কাজী নজরুল ইসলামের ব্যতিক্রমধর্মী নতুন কবিতার জন্যেই ত্রিশের দশকে আধুনিক কবিতার সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল। নজরুল তঁŨর কবিতা, গান, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে পরাধীন ভারতে বিশেষত অবিভক্ত বাংলাদেশে পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং দেশী ও বিদেশী শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কন্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার একের পর এক তাঁর গ্রন্থ ও রচনা নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, শেষ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার ও কারাদųন্ড দন্ডিত করা হয়েছিল। রাজবন্দী নজরুল প্রায় চল্লিশ দিন একটানা অনশন করে বিদেশী সরকারের জেল জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
সংগীতজ্ঞ নজরুল বাংলা সংগীতের আনুমানিক সহস্র বৎসরের ইতিহাসে সবচেয়ে সৃজনশীল মৌলিক সংগীত প্রতিভার অধিকারী বাণী ও সুর স্রষ্টা। সংখ্যাধিক্যের কারণেই নয় বরং বাংলা সংগীতের প্রায় সব কয়টি ধারার পরিচর্যা এবং বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসংগীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে তিনি লোকসংগীত-ভিত্তিক বাংলা গানকে উপমাদেশের বৃহত্তর সংগীত-ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। ‘নজরুল সংগীত’ বাংলা সংগীতের ‘অণুবিশ্ব’ তদুপরি উত্তর ভারতীয় মার্গ-সংগীতের খাঁটি বঙ্গীয় সংস্করণ। বাণী ও সুরের বৈচিত্রে নজরুল বাংলা গানকে মধ্যযুগীয় সংগীতের অনুসৃতি থেকে আধুনিক সংগীতে রুপান্তর ঘটান। আধুনিক বাংলা কবিতার মতো আধুনিক বাংলা গানেরও পথিকৃৎ কাজী নজরুল ইসলাম।
বাংলা চৌদ্দ এবং ইংরেজি বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য ও সংগীত তথা সংস্কৃতির প্রধান পুরুষ কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬/২৪শে মে ১৮৯৯। জন্মস্থান গ্রাম চুরুলিয়া, থানা জামুরিয়া, মহকুমা আসানসোল, জেলা বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ ভারত। খড়ের ছাওয়া যে মাটির ঘরে নজরুলের জন্ম তার পূর্বদিকে রাজা নরোত্তমের গড়, দক্ষিণে পীরপুকুর, পুকুরের পূর্ব পাড়ে হাজি পালোয়ানের কবর, পশ্চিম পারে সমজিদ। নজরুলের পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহ্, পিতা কাজী ফকির আহমদ, মাতা জায়েদা খাতুন। নজরুলের সহোদয় তিন ভাই এবং এক বোন: জ্যেষ্ঠ কাজী সাহেবজান, কানিষ্ঠ কাজী আলি হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। নজরুলের ডাক নাম দুখু মিয়া। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে কাজী ফকির আহমদের মৃত্যুর হয়, নজরুলের বয়স তখন নয় বৎসর। দশ বৎসর বয়সে নজরুল গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ঐ বয়সেই মক্তবের শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের কবরে খাদেম এবং মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজে নিযুক্ত হন। পিতার অকালমৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য নজরুলকে ঐসব দায়িত্ব পালণ করতে হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়সমূহ যথা-পবিত্র কোরআন, নামাজ, রোজা প্রভৃতির সঙ্গে মক্তব ও মসজিদ-জীবনেই নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ঐতিহ্যের সার্থক ব্যবহারে নজরুলের বাল্যজীবনের ঐ অভিজ্ঞতা খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল।
এরপর নজরুলকে দেখা যায় রাঢ় বাংলার জনপ্রিয় কবিতা, গান ও নাচের মিশ্র আঙ্গিকের লোক-নাট্য লেটো দলে। নজরুলের পিতৃব্য কাজী বজলে করিম ঐ অঞ্চলের লেটো দলের একজন নামজাদা ওস্তাদ ছিলেন। আরবী, ফারসী ও উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল এবং মিশ্রভাষায় তিনি কবিতা ও গান রচনা করতেন। খুব সম্ভবত কাজী বজলে করিমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে লেটো-দল নজরুলকে আকর্ষণ করে। ঐ অঞ্চলের অপর একজন জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়াল বাসুদেবের দলের লেটো ও কবি গানের আসরেও বিভিন্ন সময়ে নজরুল অংশগ্রহণ করেছেন। লেটো দলে নজরুল একাধারে পালা, কবিতা ও গানের রচয়িতা এবং অংশগ্রহণকারী ছিলেন। নজরুলের কবি ও সংগীত জীবনের শুরু লেটো দল থেকেই। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগও সম্ভবত: লেটো দলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়েই হয়েছিল, এ ছাড়া তাŤক্ষনিক কবিতা ও গান রচনা করার কৌশল ও তিনি কিশোর বয়সে লেটোর আসরেই রপ্ত করেছিলেন। সুতরাং নজরুলের লেটো জীবনকে তাঁর কবিতা ও সংগীত জীবনের শিক্ষানবিশীর কাল বলা যেতে পারে। লেটো দলের কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ্, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিবের সঙ্ দাতা কর্ণ, আকবর বাদশা, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ্, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদবধ প্রভৃতি।
লেটো দলের পরে ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল পুনারায় ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। শোনা যায়, নজরুলের পাড়াপড়শিরা তাuuকে প্রথমে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি করে দেন, কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই নজরুল ঐ স্কুল ছেড়ে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল বা নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক, পরবর্তীকালে তিনি তার ছাত্র সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন: ‘ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি’ আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিলো। কিন্তু আর্থিক কারণে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর নজরুলের ছাত্রজীবনে আবার বিঘő ঘটে। মাথরুন স্কুলে ছেড়ে তিন সম্ভবত প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে যোগ দেন, তারপর বর্ধমান-অশুাল বাঞ্চ রেলওয়ের এক খ্রিষ্টান গার্ড সাহেব খানসামার এবং শেষে আসানসোলে এক বেকারি ও চা এর দোকানে চাকুরি নেন। দারিদ্রের কারনে স্কুলের পড়াশুনা ত্যাগ, গার্ডের বয়বেয়ারার, আসানশোলের বেকারী ও গ্রান্ড ট্রাক রোডের চায়ের দোকানের কিশোর শ্রমিক নজরুল কৈশোরেই জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হন। আসানসোলে চা-রুটির দোকানে চাকুরির সুবাদেই তিনি পুলিশের দারোগা রফিজউল্লাহ্র সঙ্গে পরিচিত এবং তার অনুগ্রহে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। দরিরামপুর স্কুলের পর নজরুল পুনারায় নিজের এলাকায় ফিরে যান এবং সম্ভবত ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে নিউ স্কুল বা অ্যলবার্ট ভিক্টর ইন্সটিটিউশনে এবং পরে পুনরায় রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণী পযন্ত পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের পর সেনাবাহিনীতে যোগদেন। নজরুলের ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে তিনি সিয়ারসোল রাজ স্কুলের চারজন শিক্ষক-দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়- সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে, নিবারণচন্দ্র ঘটক বিপ্লবী ভাবধারায়, ফারসি শিক্ষক হাফিজ নুরুন্নবী ফারসী ভাষায় এবং প্রধান শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য-চর্চায় তাঁকে উ×yদ্ধ করেছিলেন।
নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আনুমানিক ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসের পর প্রি-টেষ্ট পরীক্ষার সময়। প্রথমে কলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম, পরে করাচি যান। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে আগষ্ট-সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন বৎসর তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং এর মধ্যে সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার-মাষ্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীতে সৈনিক জীবনের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যেও তাঁর সাহিত্য ও সংগীত চর্চা চলতে থাকে। ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলভীর কাছে তিনি ফারসি শেখেন, সংগীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে সৈনিকদের প্রমোদের জন্য সরবরাহকৃত বিভিন্ন দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্রও সহযোগে সংগীতচর্চা করেন আর গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করতে থাকেন। করাচি সেনানিবাসে রচিত এবং কলকাতায় প্রেরিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুল-রচনাবলীর মধ্যে ছিল বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী -নজরুলের প্রথম প্রকাশিত রচনা (সওগাত, মে ১৯১৯), প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, জুলাই ১৯১৯), করাচিতে রচিত অন্যান্য রচনা, গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’, কবিতা ‘আশায়’ এবং ‘কবিতা-সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচিতে থেকেও তিনি কলকাতার সমকালীন প্রধান প্রধান সাহিত্য-পত্রিকা যেমন, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভরতী, মানসী, মর্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলামন- সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতির গ্রাহক ছিলেন এ ছাড়াও তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং ফারসি কবি হাফিজের কিছু গ্রন্থ ও ছিল। ফলে এ কথা বলা যায় যে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য-চর্চার শুরু করাচি সেনানিবাসে।
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ৪৯ বেঙ্গলি ব্যাটেলিয়ান ভেঙ্গে দেওয়া হলে নজরুল দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতায় তাঁর সাহিত্যিক- সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রীটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-সমতি’র অফিসে ঐ সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফফর আহমদের সঙ্গে একই ঘরে বসবাস করতে থাকেন। কলকাতায় সাহিত্যিক -সাংবাদিক জীবনের শুরুতেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্য রচিত বাঁধন-হারা উপন্যাস এবং বোধন, শাত-ইল-আরব, ‘বাদল-প্রাতের শরাব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরুনী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ প্রভৃতি কবিতা প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের ঐ সব ব্যতিক্রমধর্মী রচনা অচিরে সাহিত্যরসিকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে, কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার তার ‘খেয়াপারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতা দুটির উচ্চসিত প্রশংসা করে বাংলার স্বারস্বত সমাজে তাঁকে স্বাগত জানান। ‘বঙ্গীয় মুসলামান-সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে তিনি মোজাম্মেল হক, আফজালুল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা প্রমুখ মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ট হন। অপরদিকে সমসাময়িককালে কলকাতার দুটি জমজমাট সাহিত্যিক আড্ডা ‘গজেনদার আড্ডা’ এবং ভারতী’র আড্ডায় তিনি অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন গোম্বামী, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, মোহিতলাল মজুমদার, সৌরীন্দ্রমোহন মুখ্যোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কyর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র (পরে ডক্টর) সঙ্গে ১৯২১ সালের অক্টোবরে শান্তিনিকেতন গিয়ে তিনি ররীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন।
নজরুলের সাংবাদিক-জীবন শুরু হয় করাচি সেনানিবাস থেকে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-জীবন শুরু হবার মাস তিনেকের মধ্যেই। এ. কে. ফজলুল হকের সম্পাদনায় মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের যুগ্ম- সম্পাদনায় অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের পেক্ষাপটে সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হয় ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুলাই। নজরুলের লেখা ‘মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে ?’ প্রবন্ধের জন্য ঐ বছর আগষ্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে পত্রিকাটির জামানত বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের দৃষ্টি পড়ে। নবযুগ পত্রিকার সাংবাদিকরূপে তিনি যেমন একদিকে স্বদেশী ও আর্ন্তজাতিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন, তেমনি মুজফফর আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভাসমিতিতে সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত থেকে সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হচ্ছিলেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরোয়া আসর ও আড্ডায় সংগীতও পরিবেশন করছিলেন। নজরুল তখন ও গান লিখে নিজে সুর করতে শুরু করেননি, তবে তাঁর কিছু কবিতা সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ প্রকাশ করেছিলেন। সেকালের ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্ত। কলকাতায় নজরুলের সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবনের সূচনা-পর্বে সওগাত পত্রিকায় প্রথম গান প্রকাশিত হয় ‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন’ (বসন্ত-মোহিনী, দাদরা) ১৩২৭ সালের বৈশাখ সংখ্যায়। ১৩২৭ সালে নজরুলের আরো কয়েকটি গান প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, যার কয়েকটির সুর ও স্বরলিপিকার মোহিনী সেনগুপ্তা। গানগুলি ‘হয়তো তোমার পাব দেখা’, ‘ওরে এ কোন ¯স্নেহ সুরধুনি।’
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের এũপ্রল-জুন মাস নজরুলের জীবনের জন্য তাৎপর্যমপূর্ণ সময়, কারণ এই সময়ের মধ্যে তিনি কলকাতায় ‘বঙ্গীয়-মুসলামন-সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে পরিচিতি স্কুলপাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সঙ্গে প্রথমে কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে যান, সেখানে প্রমীলার সঙ্গে পরিচিত হন। পরে দৌলতপুর গিয়ে আলী আকবর খানের অথিথিরূপে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। এখানেই আলী আকবর খানের ভাগ্নী নার্গিসের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয় ১৩২৮ সালের ৩রা আষাঢ় (১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জুন) তারিখে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিবাহের রাত্রেই নজরুল দৌলতপুর ত্যাগ করেন এবং নার্গিসের সঙ্গে তাঁর আর কখনো দেখা হয়নি। দৌলতপুর থেকে ফিরে নজরুল কুমিল্লায় প্রমীলাদের বাড়িতে একপক্ষ কালের ওপর অবস্থান করেন এবং কলকাতা ফিরে যান। নার্গিসের সঙ্গে নজরুল ঘর না বাঁধলেও কিংবা আর কখনো দেখা না হলেও নার্গিসকে যে তিনি গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন এবং তাঁদের এই বিচ্ছেদ যে নজরুলের হৃদয় গভীর ক্ষত ও স্থায়ী বেদনার সৃষ্টি করেছিল তার পরিচয় পরবর্তীকালে রচিত নজরুলের বহু গান ও কবিতায় পাওয়া যায়।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে দৌলতপুরে নার্গিসের সঙ্গে বিবাহসংক্রান্ত দুঃখজনক ঘটনার পর কলকাতায় ফিরে যাবার পথে নজরুল ১৭ দিন কুমিল্লায় ছিলেন। এ সময় অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা উদ্বেলিত, নজরুল কুমিল্লায় বিট্রিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের সভা ও শোভাযাত্রায় যোগ দিয়ে গাইলেন, সদ্যরচিত ও নিজের সুর দেওয়া স্বদেশী গান, ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী- মা’র আঙিনায়,। ‘আজি রক্তনিশি ভোরে, এ কি এ শুনি ওরে, মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খল ইত্যাদি স্বদেশী গান। এভাবেই কলকাতার সৌখিন গীতিকার ও গায়ক কুমিল্লায় অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান ক’রে পরাধীনতার বিরুদ্ধে জাগরণী গান রচনায় মধ্য দিয়ে স্বদেশী সংগীত রচয়িতা ও চারণ কবিতে রুপান্তরিত হয়ে গেলেন। নজরুল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে পুনরায় কুমিল্লায় আসেন। সে বছর ২১ শে নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল, নজরুল অসহযোগ মিছিলে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও গো পুরবাসী’। ১৯২১ খিষ্টাব্দের ডিসেম্ভর মাসে নজরুল কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফিরে গিয়েই রচনা করেন তাঁর সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক ভাঙার গান- ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল করবে লোপাট’ এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতা- ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। বাংলা সংগীত ও কবিতার ইতিহাসে অমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবিখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের ইতিহাসে সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরুপে যে খ্যাতি অর্জন করেন হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার নজির নেই। স্মরণীয় যে ব্যাক্তিগত জীবনে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা অঞ্চলের নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ এবং প্রমীলার সঙ্গে উল্লেখ্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল- যিনি পরবর্তীতে তার জীবনসঙ্গিনী হন। স্মরণীয় যে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ ছাড়াও অপর একটি সুũবখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেছিলেন। তিনি এবং মুজফফর আহমদ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ৩/৪ সি তালতলা লেনের এক বাড়িতে বসবাস করেছিলেন, যে বাড়িতে প্রথম ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি গঠিত হয়, কিন্তু নজরুল কখনো কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হননি, যদিও ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের রুশ সমাজতান্তিক বিপ্লব নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের উল্লেখযোগ্য অবদান গল্পগ্রন্থ ব্যথার দান, (১লা মার্চ), কবিতার সংকলন অগ্নিবীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী (২৫ শে অক্টবর) এবং ধুমকেতু পত্রিকার (১১ই আগষ্ট) প্রকাশ। ধুমকেতু সপ্তাহের দুবার প্রকাশিত হত রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণীসহ- কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধুমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণীসহ নজরুল অচিরেই বাস্তবায়িত করেন, নজরুলের আনন্দময়ী আগমųন নামক একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হয় ‘ধুমকেতুতে ২৬ শে সেপ্টেম্বর ১৯২২। এ কবিতার জন্য ধুমকেতু অফিসে পুলিশ হানা দেয় ৮ই নভেম্বর ১৯২২। নজরুলের প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ শে নভেম্বর ১৯২২। একই তারিখে নজরুল কুমিল্লায় গ্রেফতার হন। নজরুলকে গ্রেফতার করে কলকাতায় আনা হয় এবং বিচারধীন বন্দী হিসেবে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট সুইনহোর আদলতে শুনানির সময় নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে তাঁর বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রদান করেন। ১৬ই জানুয়ারি মামলার রায় প্রকাশিত হয় এবং নজরুল এক বৎসরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন। বিচারাধীন বন্দীরুপে নজরুল ১৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি জেলে এবং ১৭ই জানুয়ারি থেকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক ছিলেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে ফেব্রæয়ারি রবীন্দ্রনাথ তাuর বসন্ত গীতি নাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন এবং পবিত্র গঙ্গোপাধ্যয়কে দিয়ে নজরুলের কাছে আলিপুর জেলে প্রেরণ করেন। রাজবন্দী নজরুল রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সম্মাননায় উল্লসিত হয়ে রচনা করেছিলেন, ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লসে’ কবিতাটি। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে নজরুলের দোলন-চাঁপা কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই এপ্রিল নজরুলকে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। ইংরেজ জেল-সুপারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ঐ দিন থেকেই তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম করেন ’’Give up hunger strike, our literature claims you’’ । টেলিগ্রাম গিয়েছিল প্রেসিডেন্সি জেলে যদিও নজরুল তখন হুগলি-জেলে। ”Addressee not found” বলে কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামটি রবীন্দ্রনাথকে ফেরত পাঠায়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে মে জেল-পরিদর্শক ডঃ আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী হুগলি জেলা পরিদর্শন করেন এবং নজরুল তাঁর আশ্বাস ও অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে অনশন ভঙ্গ করতে রাজি হন। ঐদিনই কুমিল্লা থেকে আগত বিরজাসুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। নজরুলকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জুন বহরমপুর জেলে স্থানান্তর এবং ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তিদান করা হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলে রাজবন্দী নজরুল রচনা করেছিলেন ‘এই শিকল পরা ছল’ আর বহরমপুর জেলে’জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া’ গান ও কবিতা।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের২৫ শে এপ্রিল হুগলির মিসেস এম. রহমানের উদ্দোগে কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন এবং নজরুল হুগলিতে সংসার পাতেন। প্রমীলা ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত ছিলেন, নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ তাঁর পরিবারের বিরজাসুন্দরীসহ কেউ সমর্থন করেরননি, কেবল প্রমীলার মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কুমিল্লা ছেড়ে চলে আসেন এবং নজরুল প্রমীলার বিবাহ দেন। ঐ বিবাহের ব্রাহ্ম সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং মাসিক প্রবাসী পত্রিকা অফিস থেকে প্রধানত নজরূল বিরোধতিার জন্যে সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি প্রকাশ করা হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট নজরুলের কবিতা ও গানের সংকলন বিষের বাঁশী এবং একই মাসে ভাঙার গান প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দুটি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছিল যথাক্রমে ঐ বছর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম নজরুলের গান রেকর্ড হয় ‘হিজ মাষ্টর্স ভয়েস’ কোম্পানি থেকে যদি ও ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে প্রথম নজরুলের গান রেকর্ড হয় হিজ মাষ্টর্স ভয়েস কোম্পানি থেকে যদিও ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বের তিনি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট হননি। নজরুল বহরমপুর জেলে সহবন্দী মাদারীপুর শান্তিসেনার অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাসের অনুরোধে তার চারণদলের জন্য একটি নাটক রচনা করেছিলেন। নাটকটির পাশুলিপি জেল থেকে গোপনে বাইরে পাঠাবার সময়ে হারিয়ে যায়। এই নাটকের জন্যে রচিত ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জাũলয়াত খেলছ জুয়া’ হুগলিতে এসে নজরুলের কাছ থেকে শিখে শিল্পী হরেন্দ্রনাথ দত্ত পরজ-মিশ্র সুরে রেকর্ড করেছিলেন। নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগদানের আগে একই শিল্পী নজরুলের আরও একটি স্বদেশী গান ‘পুঁথির বিধান যাক পুড়ে যাক, বিধির বিধান সত্য হোক’ এইচ.এম.ভি থেকে রেকর্ড করছিলেন। নজরুল নিজেও এ সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে স্বরচিত স্বদেশী গান পরিবশন করতেন, যেমন, তার একটি জনপ্রিয় গান ‘ঘোর ঘোর রে ঘোরে আমার সাধের চরকা ঘোর’ ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপস্থিতিতে পরিবেশন করেছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিক থেকে নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দেন; তিনি কুমিল্লা, মেদিনীপুর, হুগলি, ফরিদপুর, বাঁকুড়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও আন্দোলনে যোগদান করেন। এ সময়ে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ছাড়াও শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের জন্য সংগঠন ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি সাপ্তাহিক লাঙল পত্রিকার প্রধান পরিচালক ছিলেন, পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর এবং প্রথম সংখ্যাতেই নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কবিতাসমষ্টি সংকলিত হয়। লাঙল বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণীসচেতন পত্রিকা।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের কৃষ্ণানগর-জীবনের শুরু। কৃষ্ণনগরে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল বাংলা সংগীতের এক নতুনন ধারা যোগ করেন। রাজনীতিতে তিনি যেমন কেবল কংগ্রেসের ‘স্বরাজ’ আন্দোলনের মধ্যে সীমাবন্ধ না থেকে শ্রেণীসচেতন শ্রমিক-কৃষক সংগঠন এবং তাদের জন্যে ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাসমষ্টি রচনা করেন তেমনি সংগীতের ক্ষেত্রেও স্বদেশী গানকে স্বাধীনতা ও দেশাত্মবোধের মধ্যে মীমিত না রেখে সর্বহারা শ্রেণীর গণসংগীতে রূপান্তরিত করেন। ১৯২৬ খিষ্টাব্দের মে মাসে নজরুল উগ্র সাম্প্রাদায়িক পেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে দিলীপকুমার রায় ও সহশিল্পীদের নিয়ে পরিবেশন করেন অদ্যাবধি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রচিত সবচচেয়ে বলিষ্ঠ সঙ্গীত ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’। বাংলা গণসংগীতের সূচনা এই ব্যতিক্রমধর্মী গানটি দিয়েই। একই সময়ে তিনি রচনাও পরিবেশন করেন কৃষ্ণনগর অনুষ্ঠিত মজুর স্বরাজ পার্টির (বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদল) সম্মেলনের কৃষাণের গান ও ‘ওঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’ আর শ্রমিকের গান ‘ওরে ধ্বংসপথের যাত্রীদল, ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল’। স্মরণীয় যে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নজরুল কলকাতায় প্রথম বামপন্থী সাপ্তাহিক গণবাণীর জন্যে রচনা করেছিলেন কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনাল, রেডফ্ল্যাগ ও ‘শেলীর ভাব-অবলম্বনে’ যথাক্রমে ‘জাগো অনশন ‘বন্দী’, ‘রক্তপতাকার গান’, এবং জাগর-তূর্য। ঐসব গানের মাধ্যমেই ১২ই আগষ্ট থেকে বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক মুখপাত্র গণবাণী ও লাঙল একত্র হয়ে গণবাণী নামে প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের প্রকাশনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গল্প-সংকলন রিক্তের বেদন, কবিতা ও গানের সংকলন চিত্তনামা, ছায়াটন, সাম্যবাদী ও পূবের হাওয়া।
নজরুলের পত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর পূর্ববঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চ পরিষদের সদস্যপাদের জন্য প্রতিদ্বন্দিতা। কিন্তু সীমিত সংখ্যক ভোটারের ভোটের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিতে তিনি পূর্ববঙ্গের জাঁদরেল মুসলমান জমিদারদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। তবে এই নির্বাচন-উপলক্ষে নজরুলকে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক সফর করতে হয়েছিল- বিশেষত তদানীন্তর ঢাকা বিভাগে। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই সেপ্টেম্বর কৃষ্ণনগরে কবির প্রথম পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়। এ বছরে প্রকাশিত তাঁর প্রন্থগুলি মধ্যে ছিল প্রবন্ধ-সংকলন দুর্দিনের যাত্রী ও রুদ্রমঙ্গল আর কবিতা ও গানের সংকলন সর্বহারা। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর-জীবনে স্বদেশী সংগীত রচয়িতা ও সুরকার অর্থাৎ চারণ নজরুলের সৃজনশীল সংগীত-প্রতিভার দ্বিবিধ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। নজরুল একদিকে হয়ে ওঠেন সাম্যবাদী গণসংগীতের প্রবর্তক, অপরদিকে বাংলা গজল গানের ¯স্রষ্টা। ‘গণসংগীত’ ও ‘গজলে’ যৌবনের দুটি বিশিষ্ট গুণ সংগ্রাম ও প্রেমের প্রতিফলন ঘটে। গণসঙ্গীত সংযোজন করে নজরুল বাংলা গানে পৌরুষ সঞ্চার আর গজলের মাধ্যমে বাংলা গানকে নবযৌবন দান করেন। ১৯২৬-২৭ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর-জীবনে নজরুল-রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির তালিকা পর্যালোচনা করলে আমাদের বক্তব্য প্রমাণিত হবে। ওঠরে চাষী জগদ্বাসী ধর ক’ষে লাঙ্গল, ধ্বংসপথের যাত্রীদল ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল, আমরা নীচে পড়ে রইবনা আর শোনরে ও ভাই জেলে, দুর্গম গিরি কান্তার মরু, আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল, বাগিচায় বুলবুলি তুই, আসে-বসন্ত ফুলবনে, মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে, বসিয়া বিজনে কেন একা মনে, দুরন্ত বায়ু বহে পুরবইয়া, আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে কে, আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান, ওরে ও শ্রমিক, সব মহিমার উত্তর অধিকারী, এত জল ও কাজল চোখে, করুণ কেন অরুন আখিঁ, ভুলি কেমনে আজো যে মনে, কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে, আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়, আসিলে এ ভাঙা ঘরে, কেন দিলে এ কাঁটা, চেয়োনা সুনয়না, কে বিদেশী বন-উদাসী, বসিয়ে নদীকূলে, পরদেশী বঁধুয়া, সখী বলো বঁধুয়ারে নিরজনে, নিশি ভোর হল জাগিয়া, চল চল চল, এ বাসি বাসরে, এ আঁũখজল, নহে নহে প্রিয়, আজি ও কুসুমহার, কেন কাঁদে পরান কি বেদনায় প্রভৃতি। এ সময়ে নজরুল গানের সুর নিজেই স্বরলিপি করে প্রকাশ করতে থাকেন। ঐসব উদাহারণ থেকে স্পষ্ট হয় যে নজরুলের মৌলিক সৃজনশীল সংগীতপ্রতিভার প্রথম õyরন, ঘটে ১৯২৬-২৭ খ্রিষ্টাব্দে। নজরুলের কৃষ্ণনগর-জীবন ছিল অভাব-অনটন রোগ-শোক দারিদ্র ক্লিষ্ট, কিন্তু তারই মধ্যে তিনি ‘দারিদ্র্য’ খালেদ-এর মতো অনুপম কবিতা আর বাংলা সংগীতভুবনে অভিনব গণসংগীত ও গজল গান সৃষ্টি করেন। অথচ তখন পর্যন্ত তিনি কোনো প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হননি যদিও বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় ও সাহানা দেবী নজরুলের ঐসব সৃষ্টিকে বিভিন্ন আসরে পরিবেশন ক’রে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন আর সংগীতশিল্প হরেন্দ্রনাথ দত্ত নজরুলের দুটি স্বদেশী গান (জাতের নাম বজ্জাতি সব এবং পুঁথির বিধান যাক পুড়ে) ইতিমধ্যে এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড করেছিলেন।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে ফ্রেব্রyয়ারি নজরুল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এর প্রথম বার্ষিক সম্মেলন যোগদান করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি ‘আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালী’ সংগীত এবং ‘খালেদ’ কবিতার আবৃত্তি পরিবেশনা করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে সাপ্তাহিক শনিবারে চিঠি-তে অমুসলমান বিশেষত ব্রাহ্ম সমাজের এক অংশ এবং অপরদিকে গোঁড়া মুসলমান সমাজ থেকে ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্পণ, প্রভৃতি পত্রিকার তীব্র নজরুল-সমালোচনা শুরু হয়। শনিবারের চিঠি তে ১৩৩৩ সালের আষাঢ় থেকে ১৩৩৪ সালের কার্তিক পর্যন্ত প্রচন্ড নজরুল সমালোচনা এবং নজরুলের বিভিন্ন রচনার প্যারডি প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুলকে সমর্থন জানায় কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি প্রগতিশীল পত্রিকা। এ সময়ে নজরুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক সাহিত্যিক বিতর্কে অবতীর্ণ হন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি কলেজ ‘রবীন্দ্র-পরিষদে’ এক ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ‘রক্ত’ অর্থে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার আপত্তি জানান, তবে ‘হত্যা’ অর্থে খুন শব্দের ব্যবহারে তার কোনো আপত্তি ছিল না। নজরুল ‘রক্ত’ অর্থে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে নিজের বক্তব্য ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’ নামক প্রবন্ধে অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেন। শেষ পর্যন্ত প্রথম চৌধুরী ‘বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা’ নামক প্রবন্ধ লিখে ঐ বিতর্কের আবসান ঘটান।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রzয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নজরুল ‘মুসুলিম সাহিত্য সমাজের’ দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য ঢাকায় আসেন। কবি আদুল কাদির জানিয়েছেন, এ সময়ে সাহিত্য সমাজের সৈয়দ আবুল হোসেনের বিশ্ববিদ্যালয় আবাųস নজরুল তাuর বিখ্যাত ‘চল চল চল’ গানটি রচনা করেন। ঢাকায় সেবার অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কবি বুদ্ধদেব বসু ও কবি অজিত দত্ত এবং গণিত বিভাগের ছাত্রী ফজিলাতুননেসার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। জুন মাসে পুনারায় ঢাকা এলে রানু সোম ও উমা মৈত্রের (লোটন) সঙ্গে নজরুলের পরিচয় এবং সঙ্গীতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।
১৩৩৫ (১৯২৮ খ্রিঃ) সালের ১৫ই জ্যৈষ্ঠ নজরুলের মাতা জায়েদা খাতুন চুরুলিয়ায় ইন্তেকাল করেন। ১৩৩৫ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় নজরুল-বিরোধিতা শুরু হয়, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের পরিচালনায় মাসিক ও সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকা বলিষ্ঠতার সঙ্গে নজরুলকে সমর্থন করে যায়। নজরুল এ সময়ে সওগাত এ যোগদান এবং সাপ্তাহিক সওগাত’র ‘চানাচুর’ নামক রম্য বিভাগটি পরিচালনা করেন। সাপ্তাহিক সওগাত এ নজরুলের সমর্থনে ‘নজরুল সংবর্ধনা’ নামক বিশেষ স্তҮ খোলা হয়। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর মোহাম্মদী পত্রিকায় নজরুল বিরোধিতার তীব্র সমালোচনা করে নজরুল-সমর্থনে ‘অনলপ্রবাহের’ কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী সওগাত- এ বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন। উল্লেখ্য, বিশের দশকে সাহিত্যক্ষেত্রে নজরুলের আবির্ভাবের স্বল্পকালের মধ্যেই, নজরুল প্রতিভার সপক্ষে সওগাত পত্রিকার মাধ্যমে একরুপ আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৩৩৪ সালেই সওগতা- এ প্রকাশিত ‘কাব্যসাহিত্যে বাঙালী মুসলমান’ শীর্ষক নিবন্ধে আবুল কালাম শামসুদ্দীন নজরুলকে ‘যুগ প্রবর্তক’ কবি এবং ‘বাংলার জাতীয় কবি’রুপে আখ্যায়িত করেন।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নজরুল চট্টগ্রামে সফরে যান এবং হবীবুল্লাহ্ বাহার ও শাসসুননাহার- ভাইবোনের আতিথ্য গ্রহণ করেন, ২৪ শে জানুয়ারি চট্টগ্রামে তিনি রচনা করেছিলেরন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ এবং ‘সাম্পানের গান’। তিনি তাঁর বন্ধু মুজফফর আহমদের জন্মস্থান সন্দীপও সফর করেন এ যাত্রায়। নজরুল ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি-অনুযায়ী ঐ সময়ে রেকর্ডের জন্য নজরুল রচিত গানের অপর কেই সুর দিতে পারতো না। গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণে প্রকাশিত ‘নজরুল-সঙ্গীত’ এর রেকর্ডে আঙুরবালার গাওয়া প্রথম দুটি গান ছিল ‘ভুলি কেমনে’ ও ‘এত জল ও কাজল চোখে’। নজরুলের নিজের প্রথম রেকর্ড ছিল স্বরচিত ‘নারী’ কবিতার আবৃত্তি। এছাড়া সে কালের প্রখ্যাত গায়ক কে. মল্লিক নজরুলের প্রশিক্ষণে প্রথম দুটি বিখ্যাত গজল রেকর্ড করেছিলেন। ‘বাগচিায় বুলবুলি তুই’ এবং ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’। ঐসব গান ও আবৃত্তি রেকর্ড হয়েছিল ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের দিকে আর প্রকাশিত হয়েছিল বছরের শেষ দিকে। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে যে ছয়জন শিল্পী এইচ.এম.ভি থেকে নজরুলের দশটি গান নজরুলের তত্বাবধানে কেরর্ড করেছিলেন তারা হলেন আঙুরবালা, ইন্দুবালা, মানিকমালা, উমাপদ ভট্টাচার্য, কে.মল্লিক, প্রতিভা সোম (বসু)। ঢাকার মেয়ে প্রতিভা সোমের (পরে কবি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী) রেকর্ড করা নজরুলের দুটি গান ছিল,‘স্মরণপারের ওগো প্রিয়’, এবং ‘ছাড়িতে পরান নাহি চায়’। গান দুটির রেকর্ড ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়।
নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে আর বেতার ও মঞ্চের সঙ্গে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে। এ অঞ্চলে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম রেডিও বা বেতারের যাত্রা শুরু ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে আগষ্ট কলকাতায় ইন্ডিয়ান ব্রডকাষ্টিং কোম্পানি নামে একটি প্রাইভেট কোম্পানির উদ্যোগে। নজরুল কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম অনুষ্ঠান করেন ১২-১১-২৯ তারিখে সান্ধ্য অধিবেশনে, স্বরচিত ‘নারী’ কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে। পরের বছর ৫-৮-২৯তারিখে নজরুল কলকাতা বেতারের ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রজনী’ অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন । বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানি ও কলকাতা বেতারের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক অসুস্থতার পূর্ব সময়ে পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। নজরুল কলকাতা মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্কিত হন ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে। ঐ বছর মনোমোহন থিয়েটারে প্রথম মঞ্চস্থ শচীন সেনগুপ্তের রক্তকমল নাটকের জন্য নজরুল ৯টি গান রচনা ও সুর সংযোগন করেছিলেন, যদিও নাটকটি মঞ্চস্থ হবার সময়ে ৭টি গান ব্যবহৃত হয়েছিল। শচীন সেনগুপ্ত ঐ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দেই মন্মথ রায়ের মহুয়া নাটকের জন্য নজরুল ১৫টি গান রচনা ও সুরারোপ করেন, একই বছর মঞ্চস্থ মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাহাঙ্গীর নাটকের জন্য নজরুল রচনা করেছিলেরন ‘রঙমহলের রঙমশাল মোরা আমরা রুপের দীপালি’। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের চাঞ্চল্য-সৃষ্টিকারী নাটক কারাগারে নজরুলের ৮টি গান ছিল, নাটকটি একটানা ১৮ রজনী মঞ্চস্থ হবার পর সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর কলিকাতা অ্যালবার্ট হলে বাOŨলি পক্ষ থেকে নজরুলকে এক বণΠŨŋƏ জাতীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। এই সংবর্ধনা-অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট বিঞ্জানী আচার্য প্রফুল্ল-চন্দ্র রায়, কবিকে প্রদত্ত অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন ব্যারিষ্টার এস.ওয়াজেদ আলি। সভাপতি কবির হাতে রুপোর আধারে সোনার দোয়াত কলম উপহার তুলে দেন, সভায় শুভেচ্ছা ভাষণ প্রদান করেণ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কবির দ্বিতীয় পুত্র সব্যসাচীর জন্ম হয় মে মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষে নজরুলের প্রাণপ্রিয় চার বৎসর বয়স্ক পুত্র বুলবুল বসন্তরোগে ইন্তেকাল করেন। বুলবুলের রোগশয্যায় বসে নজরুল আনুবাদ করেছিলেলন বুলবুল-ই-সিরাজ হাফিজের রুবাইয়াত। ইতিমধ্যে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের কবিতা ও গানের সংকলন ফাণি-মনসা এবং পত্রোপন্যাস বাঁধনহারা, ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কাব্য সিন্ধু হিন্দোল, কবিতা সংকলন সঞ্চিতা, গজল গানের সংকলন বুলবুল, কাব্য জিঞ্জির, ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে কাব্য চক্রবাক, গানের সংকলন চোখের চাতক, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা, অনুবাদকাব্য রুবাইয়াত-ই-হাফিজ, গানের সংকলন নজরুল-গীতিকা, নাটিকা ঝিলমিলি এবং কবিতা ও গানের সংকলন প্রলয়-শিখা ও চন্দ্রবিন্দু প্রকাশিত হয। শেষোক্ত গ্রন্থদুটি বাজেয়াপ্ত এবং প্রলয়শিখার জন্যে নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৩০ মামালার রায়ে ছয় মাস সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ হয়। নজরুল হাইকোর্টে আপিল ও জামিনলাভ করেন। ইতিমধ্যে গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে হাইকোর্ট কর্তৃক নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা খারিজের আদেশ দেওয়া হয়, ফলে নজরুলকে কারাবরণ করতে হয়নি।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন সাহিত্যবার্ষিকী বর্ষবাণী-সম্পাদিকা জাহান আরা চৌধুরীর সঙ্গে নজরুল দার্জিলিং ভ্রমণে যান, রবীন্দ্রনাথ তখন দার্জিলিংয়ে অবস্থান কųরছিলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দার্জিলিয়ে দেখা করেন, তাuদের মধ্যে দেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের জন্ম হয়। এ বছরে প্রকাশিত নজরুলের গ্রন্থাবলীর মধ্যে ছিল উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা, গল্প-সংকলন শিউলিমালা, স্বরলিপি নজরুল-স্বরলিপি এবং গীতিনাট্য আলেয়া। নজরুল রচিত নাটকসমূহের মধ্যে এ বছরে কলকাতা মঞ্চে আলেয়া সর্বপ্রথম মঞ্চস্থ হয় নাট্যকিতনে (৩রা পৌষ ১৯৩৮)। পুস্তকাকারে প্রকাশিত আলেয়া নাটকে গানের সংখ্যা ২৮টি, তবে মঞ্চে অভিনয়ের সময় সবগুলি গান ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা বলা কঠিন। ঐ বছর নজরুল আরা যেসব নাটকের জন্য গান রচনা বা সুর করেছিলেন, সেগুলি হল যতীন্দ্রমোহন সংহের ধ্রæবতারা উপন্যাসের হেমেন্দ্রকুমার রায়ের নাট্যরূপ ধ্র্রুবতারা। এই নাটকের হেমেনদ্রকুমার রায়ের ৪টি গানে সুরারোপ, নাট্যনিকেতনে প্রথম মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের সাবিত্রী নাটকের ১৩টি গান রচনা ও সুরসংযোজনা। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাকতা বেতার থেকে মন্মথ রায়ের মহুয়া নাটকটি প্রচারিত হয়, এ নাটকের গানগুলো ছিল নজরুলের রচনা।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে নজরুল সিরাজগঞ্জে বঙ্গীয় সুসলিম তরুণ সম্মেলনে যোগদান করেন। তার সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট কন্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সিরাজগųঞ্জ নজরুল ‘অনলপ্রবাহ’-খ্যাত কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঐ বছর ২৫ ও ২৬ শে ডিসেম্বের কলকাতা অ্যালবার্টহলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের পঞ্চম অধিবেশনে নজরুল যোগদান করেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কবি কায়কোবাদ। সভায় কায়কোবাদ নজরুলকে মাল্যভূষিত করেন আর নজরুল কায়কোবাদকে কদমবুসি বা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। প্রবীণ ও নবীন দুই কবির এই মিলন স্মরণীয় ঘটনা। ১৯৩২ সালে নজরুলের প্রকাশনার মধ্যে সবগুলিই ছিল গীত-সংকলন, যেমন সুরসাকী, জুলফিকার, বনগীতি। বস্তyত নজরুলের সাহিত্যকর্মের অধিকাংশই ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল, পরের প্রকাশনা প্রায় সবই ছিল সংগীত- সংকলন।
১৯৩২ থেকে ১৯৩৩ এক বছর নজরুল মেগাফোন রেকর্ড কোম্পপানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ সময়ে তিনি মেগাফোন কোম্পনির কাছে তার গানের স্বত্ব বিক্রয় করেন। যদিও মেগাফোন থেকে প্রকাশিত নজরুল রচিত অধিকাংশ গানের সুর নজরুলের নিজেরই ছিল। কিন্তু স্বত্ব বিক্রয় করে দেবার ফলে গ্রামোফোন কোম্পনিতে অন্য সুরকার কর্তৃক নজরুলের গানের সুর করার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠত হয়। মেগাফোন কোম্পনিতেই ঐ রেওয়াজ চালু হয়েছিল। মেগাফোন কোম্পানির প্রথম দুটি নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড ছিল ধীরেন দাসের গাওয়া ‘জয় বাণী বিদ্যাদায়িনী’ও লǙŪ মা তুই। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে ফিরে আসেন এক্সক্লyসিভ কমপোজার রুপে চুক্তিবন্ধ হয়ে। তখন থেকে এইচ.এম.ভিতে রেকর্ড-করা গানগুলি কোম্পানির সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায় এবং কোম্পানি অন্য ট্রেনার ও সুরকার দিয়ে নজরুলের গান রেকর্ড করার আইনগত অধিকার লাভ করে। এই অধিকারের কেমন অপব্যবহার করা হয় তার দু-একটি উদাহরণ: শিল্পী সিদ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় নজরুলের সুর ও প্রশিক্ষণে রেকর্ড করেন, যবে তুলসীততলায় প্রিয় সন্ধ্যবেলায় এবং ‘সাঁঝের পাখীরা ফিরিল কুলায়’ কিন্তু কোম্পানির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অন্য ট্রেনার ও সুরকারের প্রভাবে রেকর্ডটি বাজারে ছাড়া হয় না, বাতিল করা হয়, অন্য সুরকারের সুরে অন্য শিল্পীকে দিয়ে গান দুটি রেকর্ড করিয়ে বাজারের ছাড়া হয়। একই ব্যাপার ঘটে ‘মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা’ গানটির ক্ষেত্রেও।
ইসলাম ধর্ম বিষয়ক গান মারফতি, মুর্শিদী, কারবালার জারী, বাংলার লোকসঙ্গীতে প্রচলিত ছিল, কিন্তু বাংলা গানের নাগরিক ধারায় হিন্দু ঐতিহ্যভিত্তিক কীর্তনা বা শ্যামাসংগীতের মতো ইসলামী ঐতিহ্যভিত্তিক গান ছিল না। নজরুল আধুনিক বাংলা গানে ইসলামী ঐতিহ্যভিত্তিক হাম্দ, না’ত মর্সিয়া ছাড়াও নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ইসলামী ধারার গান সংযোজন করেন। নজরুল ইসলাম গান লিখতে শুরু করেন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। নজরুলের প্রথম যে ইসলামী গানটি হিজ মাষ্টর্স ভয়েস থেকে রেকর্ড হয় যেটি একটি নাত ‘রামজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’, শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। ১৯৩২ খিষ্টাব্দে ফেব্রyয়ারি মাসে ųরকর্ডটি প্রকাশিত হয়। ইসলামী গানের প্রথম রেকর্ড বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করে। ফলে গ্রামোফোন কোম্পানি ইসলামী গানের রেকর্ড প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলা সংগীতবিমুখ রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে সংগীতের অনুপ্রবেশ ঘটে ইসলামী সংগীতের পথ ধরে, তারপর বৃহত্তর সংগীতজগতে বাঙালি মুসলমান সমাজের উত্তরণে আর বিলম্ব ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে বাংলায় ইসলামী গান যাঁর কন্ঠে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেই মহান শিল্পী আব্বাসউদ্দীন ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, … তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘন্টার ভিতরেই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’। তখুনি সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন লিখলেন, ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।
গান দু’খানি লেখার ঠিক চারদিন পরেই কেরর্ড করা হল। এরপর কাজীদা লিখে চললেন ইসলামী গান। যার গান শুনলে কানে আঙুল দিত তাদের কানে গেল, ‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি’ নাম মোহাম্মদ বোলারে মন নাম আহ্মদ বোল। কান থেকে হাত ųছড়ে দিয়ে তন্ময় হųয় শুনল এ গান, আরো শুনল ‘আল্লা আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়’। মোহররমে শুনল মর্সিয়া, শুনল ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়’। ঈদে নতুন করে শুনল ‘এলো আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ, চল ঈদগাহে’। তিনি লিখে চললেন, ‘দিকে দিকে পুন: জ্বলিয়া উঠিছে দীন ইসলামী লাল মশাল’, শহিদী ঈদগাহে দেখ আজ জামায়েত ভারী।
শুধু ইসলামী গান নয় একই সময় নজরুল রচনা করেন অসংখ্য উৎকৃষ্ট শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন প্রতৃতি। যেমন ‘আর লুকাবি কোথায় মা কালি’ (ভারতবর্ষ, আশ্বিন, ১৩৪০), ‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ (ভারতবর্ষ, অগ্রহায়ণ, ১৩৪০), ‘আমি নন্দুদুলালের সাথে এ খেলে ব্রজনারী হোরি’ (ভারতবর্ষ, ফাল্গুন ১৩৪০)। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের ųযসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে ছিল পুতুলের বিয়ে, গুলবাগিচা, ও কাব্য আমপারা।
পবিত্র কোরআন শরীফের আমপারা অংশের কাব্যানুবাদ নজরুলের এক অমর কীর্তি। কাব্য আমপারা প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে নভেম্বর। এই অনুবাদ মুদ্রণ ও প্রকাশনার পূর্বে কলকাতার প্রখ্যাত আলেম, ইসলাম, আরবী ও কোরআন-বিশেষজ্ঞদের সামনে নজরুল তাঁর অনুবাদ পাঠ করে শোনান। প্রকাশ যে ইসলাম ধর্মের বিশেষজ্ঞরা নজরুলের অনুবাদের কয়েকটি শব্দমাত্র পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং তাঁদের অনুমোদনক্রমেই প্রকাশক কাব্য আমপারা প্রকাশ করেন। এই অনুবাদ থেকে নজরুলের আরবি ভাষা ও পবিত্র কোরআন সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস থেকে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর, এই সাড়ে তিন বৎসর নজরুল মূলত সংগীতরচনায় ব্যাপৃত ছিলেন, পাশাপাশি সাহিতকর্মের মধ্যে নজরুল অনুবাদে ব্যাস্ত ছিলেন। ঐ সাড়ে তিন বৎসরে নজরুল যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ কর্ম সমাপ্ত করেন, তা হলে রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম এবং কাব্য আমপারা। নজরুল রচিত হযরত মোহাম্মদ (দঃ) এর জীবনী মরু-ভাস্কর। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বুলবুল পত্রিকায় (পৌষ, ১৩৪০) নজরুলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, ‘বর্তমান বিশ্ব সাহিত্য’। এ প্রবন্ধটি থেকে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ের খবর পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বসাহিত্যের প্রধান দুটি ধারার কথা বলেছেন, একটি অপার মমতায় আঁকড়ে ধরে থাকা একদিকে নোগুচি, ইয়েট্স, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি। আরেকদিকে গোর্কি, যোহান বোয়ার, শ, বেজাভাতে প্রভৃতি। এই দুই ধারার মাঝখানে রয়েছেন লিওনিদ, আঁদ্রিভ, ক্লট হামসুন, ওয়াদিশল, রেঁমদ প্রভৃতি। প্রবন্ধের শেষে তিনি স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাহিত্যের মর্মকথা তুলে ধরেছেন।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল চলচ্চিত মাধ্যমের সঙ্গ যুক্ত হন। প্রথমে যে ছায়াছবিটির সঙ্গে নজরুল যুক্ত ছিলেন সেটি পাইওনিয়ার ফিল্ম-পরিবেশিত ধ্রyব, কাহিনী গিরিশচন্দ্র ঘোষ। এ ছায়াছবির পরিচালনা, সংগীতরচনা, সুর-সংযোজনা ও সংগীত পরিচালনা এবং নারদের ভূমিকায় আভিনয় ও নারদের চারটি গানে প্লে-ব্যাক করেন নজরুল, যার একটি গান ছিল মাষ্টার প্রবোধের সঙ্গে দ্বেত কণ্ঠে। ধ্রyব চিত্রের মোট আঠারটি গানের রচয়িতা গিরিশ গোষ, তবে সুর সংযোজন করেন নজরুল। মোট কথা, নজরুল প্রথম যে ছায়াছবির সরঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সেটির প্রডাকশেন নজরুলের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আকাশবাণী’র মুখপত্র বেতার জগত-এ নজরুলের দোলা লাগিল দখিনা বনে গানটির স্বরলিপি প্রকাশিত হয়,স্বরলিপিকার ছিলেন নলিনীকান্ত সরকার।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত নজরুলের গ্রন্থাবলীর মধ্যে সবগুলিই ছিল সংগীত-বিষয়ক, গীũতশতদল ও গানের মালা গীতিসংকলন এবং সুরলিপি ও সুরমুকুর স্বরলিপি-সংগ্রহ। বস্তুত ১৯২৮ খিষ্টাব্দে বুলবুল এবং ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে চোখের চাতক দুটি গীতিসংকলনের পর ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই নজরুলের সবচেয়ে বেশী গান ও স্বরলিপির বই প্রকাশিত হয়। ঐ সময়ের মধ্যে নজরুল-গীতিকা, নজরুল-স্বরলিপি, সুরসাকী, জুলফিকার, বনগীতি, গুলবাগিচা, গীতিশতদল, সুরলিপি, গানের মালা এবং সুরমুকুর প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৫ এর মধ্যে প্রকাশিত নজরুলের বুলবুল, চোখের চাতক, চন্দ্রবিন্দু নজরুল-গীতিকা, সুরসাকী, জুলফিকার, বনগীতি, গুলবাগিচা, গীতিশতদল, ও গানের মালা এই দশটি গ্রন্থে গানের সংখ্যা আট শতাধিক, তার মধ্যে রাগভিত্তিক সুর ছয় শতাধিক গানের, লোক ও কীর্তনের সুর প্রায় একশত আর স্বদেশী ও বিবিধ সুর প্রায় ত্রিশটি গানে। এই পরিসংখ্যা স্পষ্ট হয় যে, নজরুল ত্রিশের দশকের বাংলা গানকে রাগসংগীতের দুঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল গ্রামোফোন ছাড়াও চলচ্চিত্র ও মঞ্চ জগতে সক্রিয় ছিলেন। আসাদুল হকের চলচ্চিত্রে নজরুল এবং ব্রǙমোহন ঠাঁকুরের নাটকে নজরুল গ্রন্থে ছায়াছবি ও মঞ্চে নজরুলের ভূমিকার বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়। ঐবছর নজরুল তাঁর বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী ও চিত্রনাট্য-সংবলিত তার জন্মস্থান কয়লাখনি-অঞ্চলের শ্রমিকদের জীবনভিত্তিক পাতালপুরী ছায়াছবির জণ্যে সংগীত রচনা ও পরিচালনা করেন। ছবিতে শৈলজানন্দের গানও ছিল। প্রকাশ যে এই ছবির গানের জন্য নজরুল তাuর বাল্যস্মৃতি-বিজড়িত রানীগঞ্জের কয়লাখনি অঞ্চল ঘুরে আসেন। আরও প্রকাশ যে, এ ছবির জন্য গান রচনা ও সংগীত পরিচালনা ছাড়াও নজরুল নৃত্যগীতরত সাঁওতালী মেয়েদের সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে রঙমহল থিয়েটারে মঞ্চস্থ সুধীন্দ্রনাথ রাহার সর্বহারা নাটকে নজরুলের ৭টি গান ছিল। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রঙমহলে মঞ্চস্থ যোগেশ চৌধুরীর নন্দরানীর সংসার নাটকের গানগুলির সুরকার ছিলেন নজরুল। এ বছর কলকাতা বেতারে প্রচারিত জগৎ ঘটক রচিত গীতি- আলেখ্য জীবনস্রোতের গানগুলি রচনা করেছিলেন নজরুল। এ ছাড়াও ঐ বছর প্রচারিত ‘মীরা উৎসবে’ নজরুলের ‘নাচত নন্দুদুলাল’ ভজনটি ছিল।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে নাট্যনিকেতনে মঞ্চস্থ মন্মথ রায়ের সতী নাটকের ১০টি গানের রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঐ বছরে মে মাসে প্রচারিত কলকাতা বেতারের বিশেষ অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক ছিলেন নজরুল। অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায় এবং সহ শিল্পীবৃন্দ। একই বছরে কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত শান্তি দেবীর ব্যবস্থাপনায় একটি সংগীতানুষ্ঠানে নজরুল ভজন পরিবেশন করেন। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে দেবদত্ত ফিল্মস-এর গ্রহের ফের চলচ্চিত্রের কাহিনীকার ডঃ নরেশ সেনগুপ্ত, সংলাপ-রচনা প্রেমেন্দ্র্র মিত্র , পরিচালনা চারু রায়, সংগীত রচনা অর্জয় ভট্টাচার্য় আর সুর সংযোজনা ও সংগীত পরিচানায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতার থেকে মনোরঞ্জন সেনের প্রযোজনায় নজরুলের দেবীস্তুতি প্রচারিত হয়। ঐ বছর জানুয়ারি মাসে বেতার জগতে’র একটি সংখ্যার প্রচ্ছদপটে নজরুলের ছাবি ছাপা হয়। ঐ সংখ্যায় নজরুলের দেবীস্তুতি’র পরিচয় ছিল। দেবীস্তুতি প রিবেশন করেছিল ‘বাসন্তী বিদ্যাবীথি’র শিল্পীবৃন্দ। একই বছরে কলকাতা বেতারে নজরুল শনিমগুলের আসরে সজনীকান্ত দাসের ‘পথ চলতে ঘাসের ফুলের’ অনুষ্ঠানে কয়েকটি গান পরিবেশন করেন। ঐ বছরে কলকাতা বেতারে নজরুলের পুতুলের বিয়ে নাটকটি পরিবেশন করেন ‘গুহ এবং সম্প্রদায়’। কলকাতা বেতার থেকে নজরুল শুধু আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশন করতেন না, বেতার থেকে শুধু নজরুল-রচিত সংগীতালেখ্য বা রেকর্ড প্রচারিত হত না, সংগীত সম্পর্কেও বক্তব্য রেখেছেন নজরুল। কলকাতা বেতারের অনুষ্ঠানে মূল্যবান আলোচনা ছিল ‘আধুনিক বাংলা গানের গতিপ্রকৃতি’ এবং ‘গান রচনা’ বিষয়ে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রচারিত নজরুলের কথিকা। দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের ঐ দুটি রচনার একটিও পাওয়া যায়নি, অন্যথা ঐ দুটি কথিকা থেকে নজরুলের সংগীতচিন্তা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যেত।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি নিউ-থিয়েটার্সের বিদ্যাপতি (বাংলা ও হিন্দী) নির্মিত হয়েছিল নজরুলের রেকর্ড-নাটক-অবলম্বনে। এ ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় ছিলেন দেবকীকুমার বসু, সুর সংযোজনা ও সংগীত পরিচালনায় রাইচাঁদ বড়াল। একই বছর দেবদত্ত ফিল্মস্ রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের ছায়াছবি তৈরী করেছিল নরেশ মিত্রের পরিচালনায়। রবীন্দ্রনাথের গোরা ছায়াছবির সংগীত-পরিচালক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গোরা ছবিতে সাতটি গান ছিল, তিনটি রবীন্দ্র-সংগীত দুটি ųশ্লাক, বঙ্কিমচন্দ্রের সুজলাং সুফলাং শস্য শƏŨমলাং (রবীন্দ্রনাথের সুরে) আর নজরুলের আশা -ঢৌড়ী রাগে একটি গান ‘ঊষা এল চুপি চুপি’। গোরা ছবিতে রবীন্দ্র সংগীত থাকায় বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। বোর্ডের প্রতিনিধি শৈলজারঞ্জন মজুমদার আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু নরেশ মিত্র, সতু সেন ও নজরুল তিনজনে মিলে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে অনুমোদন আাদায় করে নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে জুন নাট্যনিকেতনে প্রথম মঞ্চস্থ হয় শচীন সেনগুপ্তের কালজয়ী নাটক সিরাজদ্দৌলা। এ নাটকের সংগীত রচয়িতা ও সুর সংযোজক ছিলেন নজরুল। সিরাজদ্দৌলা নাটক ও নাটকের গানগুলির অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার কারণে এইচ.এম.ভি সিরাজদ্দৌলা রেকর্ড- নাটক প্রকাশ করে, রেকর্ড অবশ্য মঞ্চনাটকে পরিবেশিত গানগুলির কিছু রদবদল করা হয়। রেকর্ড-নাটক সিরাজদ্দৌলা সে-সময়ে বাংলার ঘরে ঘরে শোনা যেত।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে দোলপূর্ণিমায় কলকাতা বেতারে চৈতন্যদেবের জন্মেৎসব উপলক্ষে প্রচারিত শ্রী শ্রী চৈতন্যলীলাকীর্তন অনুষ্ঠানে নজরুলের বর্ণচোরা ঠাকুর এল রসের নদীয়ায় গানটি প্রচারিত হয়, কিন্তু গানটি এখন লুপ্ত। ঐ বছরে কলকাতা বেতারের নজরুলের দেবীস্তুতি পুন:প্রচারিত হয়। একই বছরে প্রচারিত জগৎ ঘটকের ঝুলন গীতিচিত্রের গানগুলি ছিল নজরুল রচনা। ১৯৩৯ খিষ্টাব্দে অক্টোবর মাসে থকে নজরুল কলকাতা বেতারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কিত হন এবং তাuর প্রত্যক্ষ তত্তাবধানে অনেক মূল্যবান সঙ্গিতানুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ব্রাǙমোহন ঠাকুরের বেতারে নজরুল প্রবন্ধ অবলম্বনে আমরা সে অনুষ্ঠানের পরিচয় দেব। অনুষ্ঠাগুলির মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল পরীক্ষা নিরীক্ষা ও গবেষণামুলক এবং ব্যতিক্রমধর্মী সংগীতানুষ্ঠান হারামনি, মেল-মিলন, নবরাগমালিকা। বস্তুত এ সময় থেকে শুরু করে অসুস্থতার পূর্ব পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ খিষ্টাব্দের মধ্যে নজরুল বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর সহযোগিতায় কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে যে সংগীতানুষ্ঠানগুলি প্রচার করেছিলেন বাংলা সংগীতের ইতিহাসে তা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে বেতার জগত-এ একটি সংখ্যায় নজরুলের ছবি সহ বিজয়া সংগীতালেখ্যটি প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে কলকাতা বেতার প্রচারিত নজরুলের পরিকল্পনা-অনুযায়ী জগৎ ঘটক রচিত উদাসী ভৈরব-গীতি নাটকাটির সবকটি গান নজরুল-সৃষ্ট রাuগে রচিত ছিল, ‘অরুণ ভৈরব’, ‘আশা ভৈরবী’, শিবানী ভৈরবী রুদ্র ভৈরবী যোগিনী এবং উদাসী ভৈরব। বলা বাহল্য যে, রাগ ভৈরবের বৈচিত্র প্রদর্শনে নজরুল রচিত গানগুলি বাংলা রাগসংগীতের ক্ষেত্রে এক অভিনব সংযোজন এবং নজরুলের মৌলিক সংগীত-প্রতিভার নিদর্শন।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচাণায় শচীন সেগুপ্তের বিখ্যাত নাটক সিরাজদ্দৌলা। নাটকটির সংগীত পরিচারক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ঐ বছর নভেম্বর মাসে কলকাতা বেতার থেকে রক্তজবা নামে যে সঙ্গীতালেখ্যটি প্রচারিত হয় তার গানগুলিল মধ্যে ৭টি ছিল নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত। একই বছর ডিসেম্বর মাসে নজরুলের রচনা ও সুর সংযোজনায় প্রচারিত হয়েছিল কাফি ঠাটের রাগ রাগিণীভিত্তিক সঙ্গীতলেখ্য হরপ্রিয়া। এই আলেখ্যটিতে কাফি ঠাটের দক্ষিণ ভারতীয় রাগ শিবরঞ্জনী , সৈন্ধবী, সাবন্তী সারং, নীলাম্বরী, সাহানা এবং রামদাসী মল্লারে বাঁধা নজরুলের গান অর্ন্তভুক্ত ছিল। নজরুলের সুবিখ্যাত হারামণি অনুষ্ঠানের প্রথমটিতে ‘আহির ভৈরব, দ্বিতীয়টিতে ‘আনন্দ ভৈরব, তৃতীয়টিতে ‘বসন্ত মুখারী, চুতুর্থটিতে ‘সৌরাষ্ট্র ভৈরব, রাগের গান ছিল। ‘মেল মিলন’ অনুষ্ঠানটি ছিল রাগ রাগিণী ও ঠাটের মিল সম্পর্কিত অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে প্রচারিত ũনন্মক্ত ঠাটে বিভিন্ন রাগে প্রচারিত গানগুলির বাণী ও সুরকার ছিলেন নজরুল: ঠাট আশাবরী, কাফী, খাম্বাজ, বেলাওল, কল্যাণ, মারোয়াঁ ও বিভাস। ঐসব ঠাট ও রাগ রাগিণীর জন্য গান রচনার সাথে সাথে ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে কলকাতা বেতারের পল্লীমঙ্গল আসরে প্রচারিত কচুরীপানা গীতি আলেখ্যের জন্য নজরুল রচনা করেছিলেন ‘ধ্বংস করে এই কচুরীপানা’ গানটি। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এইচ.এম. ভি মেগাফোন টুইন ছাড়াও কলম্বিয়া, হিন্দুস্থান, সেনোলা কোম্পানি থেকে নজরুলের গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নজরুল সংগীত বিশেষজ্ঞ শ্রীব্রহ্মমোহন ঠাকুর প্রদত্ত পরিসংখ্যান-অনুয়ায়ী (নজরুল গীতির নানা প্রসঙ্গে, নাথ ব্রাদার্স, কলিকাতা) ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নজরুল এইচ.এম.ভি থেকে ৫৬৭টি টুইন থেকে ২৮০টি, মেগাফোন থেকে ৯১টি, কলম্বিয়া থেকে ৪৪টি, হিন্দুস্তান থকে ১৫টি এবং সেনোলা থেকে ১৩টি,পাইওনিয়ার থেকে ২টি, ভিয়ালোফোন থেকে ২টি এবং রিগ্যার কোম্পানি থেকে একটি মোট সহস্রাধিক রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এসব রেকর্ডের নজরুলের ১৬৪৮টি গান রয়েছে। এ পরিসংখ্যান শুধু রেকর্ডের গানের: পত্রপত্রিকা, গীতিসংকলন, স্বরলিপি, বেতার, নাটক ও পান্ডyলিপিতে বিধৃত নজরুলের গানের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত নিউ থিয়েটার্সের সাপুড়ে এবং সাপেড়া (হিন্দী) ছায়াছবির কাহিনী নজরুল ইসলামের, পরিচালক দেবকী সবু। আসাদুল হক চলচ্চিত্রে নজরুল (বাংলা একাডেমী) গ্রন্থে জানিয়েছেন, ছবিটির সংগীত- পরিচালকরূপে রাইচাঁদ বড়ালের নাম থাকলেও ছবির আটটি গানের সাতটি ছিল নজরুলের, একটি অজয় ভট্টাচার্যের, আর সবগুলি গানের সুর সংযোজক ও প্রশিক্ষক ছিলেন নজরুল। পাতালপুরী ছায়াছবির গানগুলির মতো সাপুড়ে ছায়াছবির গানেও নজরুল রাঢ় বাংলার সাঁওতালি ‘ঝুমুর’ সুর ব্যবহার করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থা মহেন্দ্র গুপ্তের দেবী দুর্গা নাটকের ১২টি গানের রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে অক্টোবর নজরুলের মধুমালা নাটক প্রথম নাট্যভারতীতে মঞ্চস্থ হয়। মধুমালা গীতনিাট্যে গানের সংখ্যা ৩৭টি,নজরুলের অপর কোন নাটকে এত গান ছিলনা।১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল বাংলার গ্রামোųফান,বেতার,চলচিত্র ও মųδর সংগীত ব্যক্তিত্ব, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ বছরেই তার স্ত্রী প্রমীলা নজরুল গুরুতররুপে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর নিҚŨঙ্গ অবশ হয়ে যায়। আমৃত্যু তিনি ঐ অবস্থাতেই স্বামীর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতার থেকৈ প্রচারিত বিভিন্ন সংগীতালেখ্যতে নজরুলের বহু গান সন্নিবেশিত ছিল। জগৎ ঘটক-রচিত ‘প্রবাহ’ গীতিকানুষ্ঠানের সংগীত-রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। নজরুলের অপর একটি বিখ্যাত রাগভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘নবরাগমালিকা’ প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এটি ছিল নজরুলসৃষ্ট নতুন রাগিণীর অনুষ্ঠান। নবরাগমালিকায় প্রচারিত ‘নির্ঝরিণী’ ‘বেণুকা’, ‘মীনাক্ষী’, ‘সন্ধ্যামালতী’, ‘বনকুন্তলা’, ‘দোলনচম্পা’, রাগিণীতে রচিত নজরুলের গানগুলি গীতিনাট্যরুপে প্রকাশিত হয়েছিল। বেতার জগত-এ ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ‘হারামণি’ পঞ্চম অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় ‘বিরাট ভৈরব’ রাগ কিন্তু গানটির সন্ধান পাওয়া যায় নি। ঐ বছরের কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুল রচিত আরো যেসব গীতি আলেখ্য প্রচারিত হয় সেগুলো ছিল ‘জিপসীদের সঙ্গে’, ‘ইরানের স্বপ্ন’ বিভিন্ন সারঙ্গ রাগের ভিত্তিক ‘সারঙ্গ রঙ্গ,’ এতে অন্তভুক্ত ছিল, সাবন্ত সারঙ্গ, লঙ্কদহন সারঙ্গ, বৃন্দবনী সারঙ্গ সহ দুধ সারঙ্গ, মধুমাধবী, রক্তহংস সারঙ্গ ও গৌড় সারঙ্গ রাগে রচিত ৮টি গান। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ষষ্ঠ হারামণি অনুষ্ঠানে ‘বাঙাল ভৈরব’ রাগে বাঁধা ১৪ মাত্রার ঝুমরা তালে নিবদ্ধ নৃত্যকালী শংকর সঙ্গে নাচে অতি রুদ্র বিভঙ্গে প্রচারিত হয়। একই বছরে নজরুলের রচনা ও সংগঠনায় বাসন্তিকা নাটকের গানুগুলি ‘বাসন্তীকুঞ্জ’ অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। ঐ বছর মে মাসে ‘মহিলা মজলিসে’ সুগোপন নামে নজরুলের একটি নাটক প্রচারিত হয়। নাটকটি পাওয়া যায় নি। ঐ বছর ২৫ শে বৈশাখ বেতারে রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিদের স্বরচিত কবিতা-পাঠের আসরে নজরুল যোগদান করেন। একই মাসে ‘নবরাগমালিকা, ‘ছোটদের আসরে নজরুলের নাটক জাগো সুন্দর চির কিশোর এবং সংগীতালেখ্য ‘বাংলার গ্রাম’ প্রচারিত হয়। ‘বাংলার গ্রাম’ সংগীতালেখ্যটিও হারিয়ে গেছে।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নজরুলের গীতিচিত্র ‘অতনুর দেশে’ আর জুন মাসে যাম যোজনার কড়ি মাধ্যম’ টোড়ি, গৌড় সারঙ্গ, মুলতানা, পুরবী, ছায়ানট বেহাগ ও পরজ এই আটটি রাগের মধ্যে দিয়ে প্রদর্শিত হয়। একই মাসে ধানেশ্রী (ভৈরবী ঠাটে) রাগে ‘সন্ধ্যামালতী যবে ফুলবনে ঝুরে’ প্রচারিত হয় সপ্তম হারামনিতে, এ গানটির স্বরলিপি আগে মাঘ ১৩৪৫এর ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। জুলাই মাসে প্রচারিত হয় ‘পল্লীমঙ্গল’ আসরে নজরুলের ‘বর্ষা মোদের প্রাণ’ গীতিকা। একই মাসে অষ্টম ‘হারামণি’ অনুষ্ঠানে প্রতাপবরালী রাগ আদ্ধকাওয়ালী তালে প্রচারিত হয়। ঐ মাসে আরো প্রচারিত হয় শ্যামাসংগীতালেখ্য ‘এসো মা’ নজরুলের রচনা ও সংগঠনায়। এই গীতি-আলেখ্যাটিও নিখোঁজ। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের নবম ‘হারামণি’ অনুষ্ঠনে প্রচারিত হয় পটমঞ্জরী রাগ। এ মাসে আরো প্রচারিত হয়েছিল নজরুল রচিত হিন্দোলা গীতানুষ্ঠান এবং শ্রীকৃষ্ণের ও কলকাতা বেতারের জন্মদিনে ‘আকাশবাণী’ গীতিকাটি। আকাশবাণীর গানগুলি বেতার জগত এ প্রকাশিত হয়। ঐ বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রচারিত হয় গীতিচিত্র যাযাবর বেদিয়া গানের সুরের ভিত্তিতে এটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই মাসে দশম হারামণি অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় ‘রামদাসী মল্লার’ রাগ এবং গিরিধারী শ্রীকৃষ্ণ নামে ৪০ মিনিটের একটি গীতি আলেখ্য। নজরুল রচিত এই আলেখ্যটিও লুপ্ত। অক্টেবর মাসে প্রচারিত হয় গীতচিত্র ‘আগমনী’ আর একাদশ ‘হারামণি’ অনুষ্ঠানে লুপ্তরাগের পুনরুদ্ধার ‘ভিখার’ দুটির একটিরও কোন খোঁজ নেই। আকাশবাণী ইরানের স্বপ্ন সারঙ্গরাগ পুনরায় প্রচার করা হয়। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রচারিত হয় দ্বাদশ হারামণি অনুষ্ঠানে ‘নভরোচিক’ বা ‘নওরোচিকা’ আর ‘গুলবাগিচা’ নামে গজল বিচিত্রা। এ মাসে আরো প্রচারিত হয় ‘যুগলমিলন’ কীর্তন-বিচিত্রা, এটিও লুপ্ত।
শুধু কলকাতা বেতার কেন্দ্র নয় ঢাকা বেতার থেকেও নজরুলের অনেক গান প্রচারিত হয়েছিল। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের পরিচালনায় তার রচিত গীতিবিচিত্রা পূর্বালী প্রচারিত হয়। তারও আগে ঢাকা তোর থেকে প্রচারিত শচীন সেগুপ্তের ঝড়ের রাতে নাটকের গানগুলির সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সংগীতানুষ্ঠানগুলি নজরুলের নব নব সৃষ্টিসম্ভারে যে ভাবে ঐশ্বর্যশালী হয়ে উঠেছিল তার কোন তুলনা নেই। ১৯৪১ সালেও ঐ প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। এ বছর বিভিন্ন সময়ে হারামণি অনুষ্ঠানে ‘হর্ষকানাড়া’, ‘কসৌলি ঝিঁঝিট,’ আনন্দী’ প্রভৃতি রাগের ওপর গান প্রচারিত হয়। বহ্মমোহন ঠাকুরের সিদ্ধান্ত, ১৯৪১-৪২ সালে প্রচারিত বিভিন্ন হারমণি অনুষ্ঠানে দরবারী টোড়ি, রবিকোষ, বিষ্ণুকোষ, বিষ্ণুভৈরব, শ্যামকল্যাণ, দেশ গৌড় নারয়ণী, চাঁদনী কেদারা, কুকুভ, গৌরী (পূরবী),গৌরী (ভৈঁরো) রাগে নজরুলে গান প্রচারিত হয় তবে এখন পর্যন্ত হারামণি পর্যায়ের সাত-আটটি অনুষ্ঠানের গান লুপ্ত বা সনাক্তকরণের অভাųব অজ্ঞাত। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতার থেকে আরো প্রচারিত হয়েছিল নজরুল রচিত গীতি আলেখ্য রাধাকৃষ্ণের বৃন্দবনলীলা বিষয়ক কলহ এবং ঈদউজ্ųজাহা। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলের আরো যেসব গীতিবিচিত্রা কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত হয় তার মধ্যে ছিল কীর্তন পদাবলীর অনুষ্ঠান ‘রূপানুরাগ, ‘হারামণি, অনুষ্ঠানে রাগ ‘বসন্ত পঞ্চম’ দোলউৎসব-উপলক্ষে আবীর কুমকুম হারামণি অনুষ্ঠানে নীলাম্বরী রাগ ছন্দিতা পঞ্চাঙ্গনা, ‘শ্রারদশ্রী’ ‘হারমণি’তে, দত্তরঞ্জনী রাগ, ‘প্রহর পরিচারিকা;। নজরুল তার ‘যাম যোজনার কড়ি মা ’এবং ‘প্রহর পরিচারিকা’ অনুষ্ঠানদুটিতে ললিত টেড়ি, গৌড় সারঙ্গ মুলতানি পূরবী ছায়নট (কল্যাণ অঙ্গের) বেহাগ ও পরজ এই আটটি রাগকে আটটি প্রহরের পরিচায়করুপে পরিবেশন করেছিলেন। শুধু সংগীত বা গীতি-বিচিত্রা নয় ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে শুক্রবার দিন প্রচারিত পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অনুষ্ঠানেও নজরুল মাঝে মাঝে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঐ বছর বেতাųর নজরুলের একটি কথিকা প্রচারিত হয়। বেতার অনুষ্ঠানে নজরুলের সংগীত প্রতিভার বিস্ময়কর রুপান্তর ঘটে। বেতারে ঐ সময়ে প্রচারিত নজরুলের প্রতিটি গানের সুর নজরুলের নিজের। গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুলের সুস্থাবস্থায় তাঁর রচিত ও সুরোরোপিত অন্তত: দশটি গানের সুর পরিবর্তন করিয়ে অন্য সুরকারের সুরে রেকর্ড করানো হয়েছিল যে, তাঁর রচিত গান কেবল তারই সুরে প্রচারিত হবে, অন্য কোন সুরকারের সুরে নয়। কবির সুস্থাবস্থায় শেষ পর্যন্ত তা-ই-হয়েছিল।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মিনার্ভা থিয়েটার সঞ্চস্থ মণিলাল গঙ্গেপাধ্যায়ের অন্নপূর্ণা নাটকের অধিকাংশ গানের রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। এ নাটকের ১৭টির মধ্যে ১৪টি ছিল ‘নজরুল-সংগীত’। একই বছর মে মাসে মিনার্ভা থিয়েটার মঞ্চস্থ আশুতোষ সান্যালের বন্দিনী নাটকের অধিকাংশ গানের সুর সংযোজনা করেছিলেন নজরুল, তবে নজরুল রচিত একটি ছাড়া সব গানের রচয়িতা ছিলেন নাট্যকার নিজে। শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের হরপার্বতী নাটকের ১১টি গানেরই রচয়িতা ও সুরকার ছিলেন নজরুল। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মিনার্ভায় মঞ্চস্থ দেবেন্দ্রনাথ রাহা রচিত অর্জুন বিজয় নাটকে ১১টি গানেরই রচয়িত ও সুর সংযোজক ছিলেন নজরুল। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে মিনার্ভা থিয়েটারের প্রথম অভিনীত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বΦƏvক আউট নাটকের ১৪টি গানের মধ্যে নজরুলে দুটি গান ছিল, তবে সুরকার ছিলেন রঞ্জিৎ রায়। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত কে.বি পিকচার্স-প্রযোজিত নন্দিনী ছায়াছবির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, এই ছবিতে নজরুলের একটি বিখ্যাত গান ‘চোখ গেল পাখীরে’ ছিল শচীন দেব বর্মণের নেপথ্য কণ্ঠে। নজরুল আর যেসব ছায়াছবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেগুলি চৌরঙ্গী বাংলা ও হিন্দী, দিকশূল এবং অভিনয় নয় যথাক্রমে ১৯৪২, ৪৩ ও ৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত। নজরুল চৌরঙ্গীর সঙ্গীত পরিচালক এবং ৮টি গানের রচয়িতা ও সুর সংযোজক ছিলেন।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক দৈনিক নবযুক পত্রিকা পুনরায় প্রকাশ করেন। নবপর্যায়ে দৈনিক নবযুগ এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, অর্থাৎ সুস্থ জীবনের শেষ পর্বে নজরুল পুনরায় সাংবাদিক জীবনে ফিরে আসেন। স্মরণীয় যে ১৯২১খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় নজরুল দৈনিক নবযুগ পত্রিকাতেই সাংবাদিক জীবন শুরু করেছিলেন। নজরুল কলকাতায় তার সাহিত্যিক সাংবাদিক জীবন শুরু করেছিলেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র ৩২ নং কলেজ wস্ট্রটের কার্যালয়ে অবস্থান করে, সুস্থ জীবনের শেষের দিকে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ও ৬ই এপ্রিল তিনি সেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’র রজত জুবিলী উৎসবে সভাপতিত্ব¡ এবং সম্ববত জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’ প্রদান করেছিলেন। এই ভাষণটিকে বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎ থেকেত তার বিদায় নেবার ভাষণও বলা যেতে পারে। এ ভাষণে তিনি বলেছিলেন, যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারের বলছি, আমায় ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিũন আমি নেতা হতে আসিনি,… আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম… সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম…।’ নজরুলের ঐ ভাষণের চার মাস পর ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই আগষ্ট (২২ শ্রে শ্রাবন ১৩৪৮ সাল) কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরলোকগমন করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল তাৎক্ষনিকভাবে রচনা করেছিলেন রবিহারা এবং ‘সালাম অস্তরবি’ কবিতা এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ শোকসংগীত। ‘রবিহারা’ কবিতা নজরুল স্বকন্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন কলকাতা বেতারে, গ্রামোফোন রেকর্ডে। আর ‘ঘুমাইতে দাও’ গানটি কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে স্বকন্ঠে গেয়েছিলেন বেতার ও গ্রামোফোন রেকর্ডে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই নজরুল নিজেও অসুস্থ এবং ক্রমশ নির্বাক ও সন্বিতহারা হয়ে পড়েন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাস থেকে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪টি বছর কবির কেটেছে এই অসহনীয় নির্বাক জীবন।
কবি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাuকে প্রথমে চিকিৎসা করেন ডাঃ ডি.এল সরকার, কিন্তু সপ্তাহখানেকের চিকিৎসায় কোন উন্নতি হয় না, কবির হাতের কম্পন এবং জিহ্বার আড়ষ্টতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জুলাই কবিকে সপরিবারে মধুপুর নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তিনি ডাঃ সরকারের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাধীন ছিলেন কিন্তু দুমাস মধুপুরে চিকিৎসায় কোন ফল হয়নি। তারপর নজরুলকে চিকিৎসা করেন রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসক কবিরাজ বিমলানন্দ তর্কতীর্থ। কবিরাজ চিকিৎসায় প্রথম দিকে কিছু সুফল পাওয়া গেলও কিছুদিনের মধ্যে কবির মানসিক ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ দেখা দেয়। ফলে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টেবর মাসে নজরুলকে ডাঃ নগেন্দ্রনাথ দে এবং ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর বসুর তত্তাবধানে কলকাতা লুম্বিনী পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়ে ভর্তি করা হয়। লুম্বিনী পার্কে নজরুল চার মাস ছিলেন কিন্তু তার অবস্থার কোন তারতম্য হয় নি। নজরুল অসুস্থ হবার পর দশটি বছর কলকাতায় ক্রমবর্ধমান বিস্মৃত জীবন যাপন করেন, কেবল ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কবিকে জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক প্রদান করা হয়। কলকাতায় বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের উদ্যোগে গঠিত নজরুল-নিরাময়-সমিতি (কাজী আবদুল ওদুদ সাধারণ সম্পাদক) কবি ও কবিপত্মীকে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে জুলাই রাঁচি মেন্টাল হসপিটালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করেন। সেখানে কবি মেজর ডিভিসের চিকিৎসাধীন ছিলেন চার মাস, কিন্তু সেখানেও সঠিক রোগনির্ণয় সম্ভব হয় নি। এর পর নজরুল নিরাময় সমিতির উদ্দ্যোগে কবিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ করা হয়।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জুন নজরুল-নিরাময়-সমিতির রবিউদ্দিন আহমদ, নজরুল, প্রমীলা ও অনিরুদ্ধকে নিয়ে জাহাজযোগে লন্ডন পৌছান। লন্ডেনে ডাঃ উইলিয়ম সার্জেন্টের প্রাথমিক পরীক্ষায় বলা হয় যে কবির আরোগ্যলাভের বিশেষ আশা নেই, তবে চিকিৎসার জন্যে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের অপর দুজন সদস্য ডাঃ এ.ই.বেটন এবং স্যার রাসেল ব্রেন ভিন্নমত পোষণ করেন। স্যার রাসেল এর মতে কবির মস্তিস্কে সেল এতটা নষ্ট হয়ে গেছে যে, তা আরোগ্যর বাইরে, কবির মস্তিস্কের পুরোভাগ সংকুচিত হয়ে গিয়েছে। ডাঃ ইউলি ম্যাকিক কবির মস্তিস্কে অস্ত্রোপচারের সুপারিশ করেন, ডাঃ ব্রেন তার বিরোধী ছিলেন। লন্ডনের বিশেষজ্ঞরা একটি বিষয়ে একমত হন যে, কবির প্রাথমিক চিকিৎসা ছিল অপরিমিত ও অসম্পূর্ণ। কবিকে অতঃপর ভিয়েনায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং ডাঃ হানস্ হফের চিকিৎসাধীন রাখা হয়। তিনিও মত দেন যে কবির ভাল হবার সম্ভাবনা নেই। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর কবিকে সপরিবারে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। বাকি জীবন নজরুলের ঐ অবস্থাতেই কাটে। কবিপত্নী প্রমীলা নজরুল অসুস্থ হয়েছিলেন ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে, পরের তেইশ বছর অবশ নিҚvঙ্গ নিয়ে প্রমীলাকে শয্যাশায়ী থাকতে হয়, তবে তার দেহের ওপরের ভাগ সুস্থই ছিল এবং বিছানা বন্দিনী প্রমীলা সংসার চালিয়েছেন, স্বামীর সেবা করেছেন। প্রমীলা নজরুল শেষ নিঃস্বাস তƏvগ করেন ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন ৫৪ বছর বয়সে (জন্ম মে ১৯০৮)। প্রমীলার ইচ্ছা-অনুয়ায়ী তাকে স্বামীর জন্মভূমি চুরুলিয়ায় সমাহিত করা হয। কবিপুত্র কাজী অনিরুদ্ধের মৃত্যু হয় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে ফেব্রyয়ারি ৪৩ বৎসর বয়সে আর কাজী সব্যসাচীর ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ ৫০ বছর বয়সে।
সুস্থাবস্থায় নজরুল শেষবার ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বার্ষিক অনুষ্ঠানে ১৯৭১ খিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কবিকে প্রদেয় পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মাসিক বৃত্তিপ্রদান অক্ষুন্ন রাখেন। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেরশের রাষ্টপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সফরে কলকাতা গেলে কবির বাসস্থানে গিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হমানের অনুরোধে ভারত সরকার কবিকে বাংলাদেশে যাবার অনুমũত প্রদান করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে বাংলাদেশ বিমানে কবিকে সপরিবারে স্বাধীন বাংলাদেশে আনয়ন করা হয় এবং তেজগাঁ বিমানবন্দরে এক বিশাল জনতা কবিকে গভীর আবেগময় অভ্যর্থনা ও বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। কবিকে বিমান বন্দর থেকে ধানমন্ডী ২৮ নং সড়কে তাঁর জন্য নিদিষ্ট কবিভবনে (বর্তমানে নজরুল ইন্সটিটিউট) নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উভয়েই কবি ভবনে গিয়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন । ঢাকায় কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়, কবিভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত থাকতো প্রতিদিন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মে বাংলাদেশে নজরুলের উপস্থিতিতে প্রথম ‘নজরুল-জয়ন্তী’ উদযাপিত হয় মহাসমারোহে কবির ৭৩তম জন্ম বার্ষিকীতে। ঢাকায় কবির স্বাস্থের উন্নতি পরিলক্ষিত হয়, তার চিকিৎসার তত্বাবধানের জন্যে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্কীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট. উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ শে ফেব্রyয়ারি একুশে পদকে ভূষিত করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে জুলাই থেকে চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক তত্তাবধায়নের জন্য নজরুলকে পি.জি. হাসপাতালের ১১৭ নং কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে আগষ্ট পর্যন্ত মোট এক বছর এক মাস আট দিন পি.জি. হাসপাতালের ঐ কেবিনটিই ছিল নজরুলের জীবনের শেষ আবাস। পি.জি. হাসপাতালে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, তাঁর শরীরে পানি দেখা দেয়। ২৭ শে আগষ্ট শুক্রবার বিকেলে তাঁর দেহে উত্তাপ্ত পরিলক্ষিত হয়। ২৯ শে আগষ্ট শনিবার সকালের পর থেকে তাঁর উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে, তিনি ব্রঙ্কো নিউমোনিয়াম আক্রান্ত হন। ২৮ শে আগষ্ট রবিবার সকালে তার দেহের উত্তাপ অস্বভাবিকরূপে বর্ধিত হয় এবং তা ১০৫ ডিগ্রি অতিক্রম করে। কবিকে অক্সিজেন দেওয়া হয়, সাক্শনের সাহায্যে কবির ফুসফুস থেকে কফ ও কাশি বের করার ও চেষ্টা চলে। শেষ চেষ্টা হিসেবে কবির শরীর স্পঞ্জ করানো হয়, কিন্তু সকল বেষ্টা ব্যর্থ করে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ (২৯ শে আগষ্ট ১৯৭৬) সকাল ১০টা ১০ মিনিটে।
বেতার ও টেলিভিশনে নজরুলের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হওয়ামাত্র দেশ বিদেশে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর কোটি কোটি বাংলাভাষীর জন্য নজরুলের দৈহিক উপস্থিতি ও ছিল অনুরেপ্ররণার উৎস ও গৌরবের বিষয়। তাঁর তিরোধানে বাঙালিমাত্রেই গভীর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেমে যায়। ঢাকার অগণিত মানুষ ছুটে যায় পি.জি. হাসপাতালে কবিকে শেষবারের মতো এক নজর দেখার জন্যে, সবারচোখে পানি। কবিকে শেষ দেখার সুযোগ দেবার জন্যে বেলা এগারটার দিকে তার মরদেহ কেবিন থেকে বের করে আউটডোরের দোতলায় মঞ্চে স্থাপনা করা হয়, কিন্তু জনতার ভিড়ে সে স্থানটি অপ্রতুল বিবেচিত হওয়ার দুপুর দুটোর দিকে কবির মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখে প্রাঙ্গনে স্থাপন করা হয়। মরদেহ অũতক্রম করে যেতে থাকে হাজার হাজার নর, নারী, শিশু; ফুলে ফুলে ডেকে যায় কবির মরদেহ। বিকেল সাড়ে চারটায় রমনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নামাজে জানাজার জন্য রৌদ্রোজ্জ্বল শরতের অপরাহ্নে লাখো মানুষের ঢল নামে। বিকেল পাচটায় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে। নজরুল গেয়েছিলেন, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। কবি চিরনিদ্রায় শায়িত ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মসজি†দর প্রাঙ্গনে, সম্মুখের ঐতিহাসিক রাজপথটি এখন ‘কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ’। স্মরণীয় যে, কলকাতা ও ঢাকা এই দুই মহানগরীল বিমান বন্দর থেকে শহরমুখী প্রধান রাজপথের নাম কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ।
নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, প্রতিবছর তার জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয় জাতীয় পর্যায়ে। কবির স্মৃতির প্রতি দেশব্যাপী নিবেদিত হয় দেশবাসীর হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য। তাঁর কবর ছেয়ে যায় পুস্পস্তবকে। বিদ্রোহী কবি ও বাংলার বুলবুল কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের কাছে জাতিয় কবিরুপে আদৃত। কারণ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান সমাজের ইতিহাসে তিনিই এখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল প্রতিভা। বিশ শতকের প্রথমাংশ বাঙালি মুসলমান সমাজ ছিল শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর। অর্থনেতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা এবং দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কারের শিকার। সেই অন্ধকার ও হতাশাচ্ছন্ন যুগে কাজী নজরুল ইসলামের মতো সৃজনশীল মৌলিক প্রতিভা ও বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের উদ্ভব পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করে, বাঙালি মুসলমান হীনমন্যতা মুক্ত হয়ে আত্মমর্যাদাবোধ ফিরে পায়, বাঙালি মুসলমান সমাজে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়, সমাজ মুধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। কাজী নজরুল ইসলামের যাদুকরী প্রতিভার সংস্পর্শে অতি অল্প সময়ে ঐ অসম্ভব কর্মটি সম্ভবপর হয়েছিল। তাই নজরুলের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজ তথ্য বাংলাদেশের মানুষের ঋণের কোন শেষ নেই।
বাঙালি মুসলমান সমাজের নবজাগরণের অগ্রদূত কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু শুধু বাঙালি মুসলমান সমাজের জন্যেই সাহিত্য ও সংগীত সৃষ্টি করেননি। বাংলার দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান সমাজে তাuর সৃষ্টি সমানভাবে আদৃত। কারণ বাংলার সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নজরুলই প্রথম ও একমাত্র সৃজনশীল প্রতিভা যিনি তাঁর সৃষ্টি-কর্মে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান ঐতিহ্যকে যথাযথভাবে রূপায়িত করেছেন। নজরুলের কবিতা ও গানে হিন্দু ও মুসলমান পুরাণ এবং ইতিহাস যেমন সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে অপর কোন কবি বা গীতিকারের সৃষ্টিকর্মে তা হয়নি। ফলে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ত্রিশ বৎসর বয়সে কলকাতা অ্যালবার্ট হলে বাংলার মুসলামন ও হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা নজরুলকে জাতীয় সংবর্ধনা পদান করেছিলেন। সেই ঐতি†হ্যরে অনুসরণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন এবং জাতীয় কবি বলে ঘোষনা করেন। কাজী নজরূল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কারণ বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ তিনি। সেজন্য শুধু বাংলাদেশের নন, বাঙ্গালীর জাতয়ি কবি, নজরুলের চেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বাঙ্গালীর হাজার বছরের ইতিহাসে আজও জন্মগ্রহণ করেননি। প্রসঙ্গক্রমে নজরুলের অমর বাণী- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’ চিরস্মরনীয়।
রফিকুল ইসলাম
চেয়ারম্যান
নজরুল ইন্সটিটিউট ট্রাষ্টি বোর্ড
নজরুলের জীবন ও সাহিত্যের কাল–নির্দেশিকা
১৮৯৯ ২৪ মে (১১ জৈষ্ঠ্য ১৩০৬) বুধবার কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম
১৯০৮ ২০মার্চ নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু
১৯১০ আর্থিক অভাবে শিক্ষা বিঘিœত। মসজিদের ইমামতি, মাজারের খাদেমগিরি ইত্যাদি কাজ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ।
১৯১১-১৯১২ শিহাড়সোল রাজ হাই স্কুলে প্রথমবার ভর্তি ও ঐ স্কুল ত্যাগ। মাথরুন নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি দুই বছর অধ্যায়ন, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে শিক্ষকরূপে লাভ।
১৯১৩ আসানসোলে রুটির দোকানে চাকরী। পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে পরিচয় এবং তার স্নেহানুকুল্য লাভ।
১৯১৪ ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার অর্ন্তগত দরিরামপুর হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন বার্ষিক পরীক্ষার পর দরিরামপুর ত্যাগ (মতান্তরে ১৯১৫ সালের মধ্যভাগে দরিরামপুর ত্যাগ)
১৯১৫ শিহাড়সোল রাজ হাই স্কুলে পুনরায় ভর্তি এবং দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন।
১৯১৭ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে করাচি গমন, ৪৯নং বাঙ্গালী পল্টনে যোগদান।
১৯১৯ লেখকরূপে নজরুলের আত্মপ্রকাশ। এই বছরে প্রথম রচনা প্রকাশ বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী ১৩২৬ এর জৈষ্ঠ্য সংখ্যা মাসিক সওগাত-এ। এ বছরে নজরুলের কবিতা প্রথম প্রকাশ, কবিতার নাম মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৬ সংখ্যা) নজরুল তখনো করাচি সেনা বিভাগে কর্মরত।
১৯২০ করাচি থেকে কলকাতায় আগমন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে বসাবাস শুরু। এপ্রিল (বৈশাখ ১৩২৭) থেকে মোসলেম ভারত পত্রিকায় বাঁধনহারা উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ শুরু, জুলাই থেকে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে নজরুল দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনের কাজে নিযুক্ত। ডিসেম্বর মাসে নজরুলের দেওঘরে গমন।
১৯২১ আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের কুমিল্লা গমন। সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে প্রণয়, বিবাহ ১৮ জুন (৩রা আষাঢ়, ১৩২৮), সৈয়দা খাতুনের নজরুলের দেওয়া নাম নার্গিস। নার্গিস পরিবারের সঙ্গে কোন বিষয়ে নজরুলের বিরোধ এবং ৪ঠা আষাঢ় ভোরে নজরুরেল দৌলতপুর ত্যাগ, অক্টোবর মাসে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে নজরুলের শান্তি নিকেতনে গমন ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিদ্রোহী রচনা।
১৯২২ ৬ জানুয়ারি সংখ্যা সাপ্তাহিক বিজলীতে বিদ্রোহী প্রকাশ, ১৩২৮ এর কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারত-এ একই সঙ্গে বিদ্রোহী প্রকাশ, মার্চ মাসে নজরুলের প্রথম গ্রন্থ ব্যথার দান প্রকাশ, ১২ আগস্ট অর্ধ সাপ্তাহিক ধুমকেতু নজরুলের উদ্যোগে প্রকাশ, ২৬ সেপ্টেম্বর ধূমকেতুতে কবির আনন্দময়ীর আগমনে এবং ১৩ আক্টোবর ভাতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী প্রকাশ, ২৫ অক্টোবর অগ্নিবীনা প্রকাশ, ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী ২৩ নভেম্বর কুমিল্লায় নজরুল গ্রেফতার।
১৯২৩ ৭ জানুয়ারি রাজবন্ধীর জবানবন্দী রচনা। ১৬ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম করাদন্ডে দন্ডিত ২২ ফেব্রæয়ারি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক গীতিনাট্য বসন্ত নজরুলের নামে উৎসর্গিত এপ্রিলে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর জেল কর্তৃপক্ষের জুলুমের বিরুদ্ধের নজরুলের অনশন ৩৯দিন পর অনশন ভঙ্গ, ডিসেম্বরে নজরুলের মুক্তি লাভ।
১৯২৪ ২৫ এপ্রিল শুক্রবার আশালতা সেনগুপ্ত-এর সঙ্গে কলকাতায় হাজী লেনে নজরুলের বিবাহ এবং হুগলীতে ঘর-সংসার শুরু। প্রথম পুত্র আজাদ কামালের জন্ম ও আকিক উৎসব। কিছুদিন পরই এই সন্তানের মৃত্যু। বিষের বাঁশি ও ভাঙ্গার গান প্রকাশিত ও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা।
১৯২৫ ফরিদপুর কংগ্রেসে গান্ধীজীর সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎ। ১৬ জুন চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু। তাঁর মৃত্যুতে অর্ঘ্য, ইন্দ্রপতন প্রভৃতি কবিতা রচনা এবং চিত্তনামা প্রকাশ। ১০ নভেম্বর The Labour Swaraj party of the Indian National Congress গঠিত হয়। ঐ পার্টির ইস্তেহার নজরুল কর্তৃক ঘোষিত ও প্রকাশিত। ১৬ ডিসেম্বর লাঙল প্রকাশিত। প্রখম সংখ্যায় সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ।
১৯২৬ ক…Ẳনগর-এ বসবাস শুরু। ১৯২৬-এর কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে নজরুলের প্রতিদ্বন্দিতা ও পরাজয়
সেপ্টেম্বরে কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল (অরিন্দম খালেদ) এর জন্ম। এই বছরে প্রথম গজল রচনা- বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে
দিস্ নে আজি দোল’।
১৯২৭ ফেব্রæয়ারি মাসে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশনে নজরুলের যোগদান ও ভাষণ প্রদান
এই বছেরে আবুল কালাম শামসুদ্দীন কর্তৃক নজরুলকে যুগ প্রবত©ক কবি’ বলে অভিহিত করণ
ডিসেম্বরে আত্মশক্তিতে, বড়র পীরিতি বালির বাঁধ প্রবন্ধ প্রকাশ।
১৯২৮ সওগাত পত্রিকায় ইব্রাহীম খাঁর পত্রের উত্তরে নজরুলের বক্তব্য প্রকাশ। ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান। মিস ফজিলাতুননেসার সঙ্গে পরিচয় ও অনুরাগ সঞ্চার
শরৎচন্দ্রের সংবর্ধনা উপলক্ষে নজরুলের গান রচনা
সাপ্তাহিক সওগাত এ নজরুলিস্তান’ কলাম প্রবর্তিত।
১৯২৯ ৯ অক্টোবর তৃতীয় পুত্র সব্যসাচীর জন্ম। ১৫ ডিসেম্বর (২৯ শে অগ্রহায়ন ১৩৩৬) রবিবার কলকাতার অ্যালবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন, প্রধান অতিথি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
১৯৩০ ৭ অথবা ৮ মে ( বৈশাখ ১৩৩৭) নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু প্রলয়শিখা ও চন্দ্রবিন্দু প্রকাশ, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা ।
১৯৩১ নজরুল Ôমর্ডান থিয়েটার্স লিমিটেড’-এর সুর-ভান্ডারী নিযুক্ত, জুন মাসে দার্জিলিং ভ্রমণ সঙ্গে বর্ষবাণী-র সম্পাদিকা জাহানআরা চৌধুরী ছিলেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথে সঙ্গে সাক্ষাৎ
১৯ ডিসেম্বর কলকাতার রঙ্গমঞ্চে নজরুলের আলেয়া প্রদর্শিত
২৪ ডিসেম্বর কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধর জন্ম।
১৯৩২ আগস্টে স্বদেশী Ô‡gগাফোন’ কোম্পানীতে নজরুলের যোগদান।
১৯৩৩ ৩ ডিসেম্বর ধ্রæব ছায়াচিত্রের জন্য গান রচনা। ঐ চিত্রে নারদের ভূমিকায় অভিনয়।
১৯৩৪ ১ জানুয়ারি ধ্রæব ছায়াছবির মুক্তি।
১৯৩৬ ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে নজরুলের সভাপতিত্ব ও অভিভাষণ দান।
১৯৩৭ (১০ জানুয়ারি) কলকাতার ওয়াছেল মোল্লা ম্যানসনের ঈদপ্রীতি সম্মেলনে নজরুলের ভাষণ Ôসাহিত্য, জীবন ও যৌবন’।
১৯৩৮ কলকাতা রেডিওতে Ôহারামনি’,Ôনবরাগ’, Ôমালিকা’, এই অনুষ্ঠানসমূহ নজরুল কর্তৃক পরিচালিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিতƏ সম্মেলনে কাব্যশাখায় সভাপতিত্ব। কবির সহধর্মিনী প্রমীলা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। ২১ জুন সিরাজউদ্দৌলা নাটকের প্রথম অভিনয় রজনী, গান নজরুলের। বিদ্যাপতি ছায়াচিত্রের কাহিনী ও গান রচনা। দৈনিক কৃষক পত্রিকার কার্যালয়ে নজরুল কর্তৃক জন সাহিত্য সংসদের উদ্বোধন।
১৯৩৯ সাপুড়ে ছায়াচিত্রের কাহিনী ও গান রচনা।
১৯৪০ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতির ঈদপ্রীতি সম্মেলনে নজরুলের অভিভাষণ।
১২ ডিসেম্বর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানে নজরুলের যোগদান।
১৯৪১ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির (৫ও ৬ এপ্রিল) রজত জয়ন্তীর সভাপতিরূপে ভাষণ দান ২৫ মে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সভাপতিত্বে কলকাতায় মহাসমারোহে নজরুল জন্মদিবস উদযাপিত। ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরপরই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে রবিহারা নামে কবিতা আবৃত্তি।
অক্টোবরে দৈনিক নবযুগ (নব পর্যায়ে) এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ।
১৯৪২ ১০ জুলাই নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯ জুলাই মধুপুরে গমন
৭ অক্টোবর কলকাতার লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যর্থ।
১৯৪৩ Ôনজরুল নিরাময় সমিতিÕ গঠিত। সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যয়।
১৯৪৫ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক Ôজগত্তারিণী’ স্বর্নপদক প্রদান।
১৯৫২ (জুলাই) Ôনজরুল নিরাময় সমিতি’ কর্তৃক কবিকে সস্ত্রীক রাঁচির মানসিক হাসপাতালে প্রেরিত চারমাস চিকিৎসার পর অপরিবর্তিত অবস্থায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন।
১৯৫৩ ১০ মে নিরাময় সমিতি কর্তৃক চিকিৎসার জন্য কবিকে লন্ডনে ও ভিয়েনায় প্রেরিত ১৫ ডিসেম্বর নিরাময় না হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন।
১৯৬০ ভারত সরকার কর্তৃক Ôপদ্মভুষণ’ প্রদান।
১৯৬২ ৩০ জুন কবি-পত্মী প্রমীলার মৃত্যু। চুরুলিয়ায় সমাধিস্থ করা হয়।
১৯৭২ ২৪ মে কবিকে বাংলাদেশে আনীত। ঢাকায় কবিভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে দেখতে যান।
১৯৭৫ ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর কর্তৃক নজরুলকে ‘ডিলিট’ উপাধি প্রদান।
১৯৭৬ জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান। ২১ ফেব্রæয়ারি Ôএকুশে পদক’ প্রদান ২৯ আগস্ট, (১২ই ভাদ্র ১৩৮৩) রবিবার সকাল ১০টা ১০মিনিটে পিজি হাসপাতালে কবি লোকান্তরিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবি সমাধিস্থ
১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় শোকসভা